দূরবীণ নিউজ ডেস্ক:
সরকারি অফিসে লাগামহীন ঘুষ, দুর্নীতি, বিদেশে অর্থপাচার, সমাজে প্রভাবশালী ও অবৈধ সম্পদের মালিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চলমান কার্যক্রমকে আরও স্বচ্ছ এবং দৃশ্যমান পর্যায়ে আনার আহবান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি দুদকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের উদ্দেশ্য করে বলেরেন,সর্ষের মধ্যে ভুত থাকলে হবে না. সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে দুদক জনগণের আস্থা হারাবে।‘সর্ষের মধ্যে যেন ভূত না থাকে।
রাষ্ট্রপতি দুদক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদে উদ্দেশ্যে আরও বলেন, ‘আপনারা জানেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় ও আপসহীন অবস্থানের জন্য ১৯৫৬ সালের কোয়ালিশন সরকারে তাঁকে দুর্নীতি দমন বিষয়ক মন্ত্রী করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কখনো দুর্নীতির সাথে আপস করেননি। বঙ্গবন্ধু ভাষণে বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। ২১ জুলাই ১৯৭৫ সালে বঙ্গভবনে জেলা গভর্নরদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “শুধু নিজেরা ঘুষ খাওয়া করাপশন নয়। এ সম্বন্ধে আমার কথা হলো- করাপ্ট পিপলকে সাহায্য করাও করাপশন। নেপোটিজম কিন্তু ‘এ টাইপ অব করাপশন’. স্বজনপ্রীতিও কিন্তু করাপশন। আপনারা এসব বন্ধ করুন।”
দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে গত ৯ ডিসেম্বর রাজাধানীর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ২০তম আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, জহুরুল হক ও দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের রেকর্ড করা বক্তব্য প্রচার করা হয়। রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশও দিবসটি পালন করছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত দুর্নীতি বিরোধী সনদ স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবসময়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার।
স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন দুর্নীতি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরী ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাসহ তাঁর পরিবারের আপনজনদের নৃশংস হত্যাকাÐের ফলে উন্নয়নের সেই গতি থমকে দাঁড়ায়। রুদ্ধ হয় গণতন্ত্র ও উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দেশে আজ গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নসহ আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে আমি কমিশনের সকল পর্যায়ের কর্মচারীদের অনুরোধ করব দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রমে আপনা সর্বোচ্চ ন্যায়নিষ্ঠতা প্রদর্শন করে। সর্ষের মধ্যে যেন ভূত না থাকে, অন্যথায় দুদক জনগণের আস্থা হারাবে।’ দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে দুদকেই কার্যকর ও সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে জানিয়ে রাষ্ট্রপতিদ বলেন, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র সকলের বেলায় একই পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষমতা দেওয়া হয় দায়িত্ব পালনের জন্য, দেখানোর জন্য নয়। তাই দুদকের সব কর্মাচারীকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে হবে।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, আপনারা জানেন দুর্নীতিতে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় ও আপোসহীন নীতির জন্য ১৯৫৬ সালে তৎকালীন কোয়ালিশন সরকারের সময় তাকে দুর্নীতি দমন বিষয়ক মন্ত্রী করা হয়েছিল। তিনি কখনো দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করেননি। তিনি বলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের পর অর্জিত আমাদের এই স্বাধানীতার অন্যতম লক্ষ্য হলো, সুন্দর, মানবিক, বৈষম্যহীন ও ন্যায় ভিত্তিক দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ। আমাদের পবিত্র সংবিধানও দুর্নীতি বিরুদ্ধে কঠোর হতে বলেছে।
সংবিধানের ২০ এর ২ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের এমন অবস্থার সৃষ্টির চেষ্টা করলে যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবে না’- এই মর্মবাণীকে ধারণ করে দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ‘দুর্নীতি শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক সমস্যা’ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, দুর্নীতি সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে, দুর্নীতি গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ও বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। আমি মনে করি, মানুষের মধ্যে দুর্নীতি বিরোধী চেতনা তৈরি ও দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তির মাধ্যমে দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আদোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, একটা সময় ঘুষখোর, সুদখোর ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা ছিল না বললেই চলে। কালের বিবর্তনে সেই মূল্যবোধ ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে। শহর, বন্দর সবখানেই টাকাওয়ালাদের জয় জয়কার। টাকা কীভাবে এলো সৎ নাকি অসৎ পথে, এসব নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। এটা নিয়ে ভাববার ফুরসতও নেই। সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি হয়ে গেছে টাকা।
সমাজের সর্বস্তরের মানুষের টাকার পেছনে ছোটাকে অসনি শংকেত অবহিত করে তিনি বলেন, চাকরিজীবী, রাজীনীতিবিদ, পেশাজীবী, শ্রমিক, ব্যবসায়ী সবাই দেখি টাকার পেছেনে দৌঁড়াচ্ছে। সরকার ও দুদক সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করে দেবে, আর আমরা বসে বসে দেখব, তা কোনোভাবেই সম্ভব না। দুর্নীতি দুর করতে হলে সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। ঘুষখোরদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বাস্তবায়িত হচ্ছে মেট্রোরেল, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী বহুমুখী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্প। মহাকাশে স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আজ অভিজাত স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রা হবে অপ্রতিরোধ্য।
রাষ্ট্রপতি বলেন, দুর্নীতি শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। দুর্নীতি সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি করে, অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। আমি মনে করি মানুষের মাঝে দুর্নীতি বিরোধী চেতনা তৈরি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমেই দুর্নীতিকে কমিয়ে আনা সম্ভব। তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। একটা সময় ছিল ঘুষখোর, সুদখোর ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ছিল না বললেই চলে।
কিন্তু কালের বিবর্তনে যেন সেই মূল্যবোধ ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে। শহর, নগর ও গ্রামগঞ্জ সবখানেই যেন টাকাওয়ালাদের জয়জয়কার। টাকা কীভাবে এলো, সৎপথে না অসৎপথে এসব নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠিই যেন হয়ে গেছে টাকার দৌরাত্য। তাই রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক সবাই কেবল টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছে। টাকা কীভাবে আসছে বা সঠিক ও সৎ পথে আসছে কী না এসব নিয়ে ভাববার কোনো ফুরসত নেই। সামাজিক-অবক্ষয় ও মানবিক মূল্যবোধ এবং মানুষের নীতি-নৈতিকতার জন্য এ অবস্থা একটি অশনিসংকেত।
তিনি বলেন, সরকার বা দুদক সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করে দেবে আর আমরা বসে বসে দেখব বাস্তবে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। দুর্নীতি দূর করতে হলে ধনী-দরিদ্র, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে সকলকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোরদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।
দুর্নীতি দমনে দুর্নীতি দমন কমিশনকেই কার্যকর ও সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। ছোটো-বড়ো, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার বেলায় একই পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষমতা দেয়া হয় দায়িত্ব পালনের জন্য, দেখানোর জন্য নয়। তাই দুদকের সকল কর্মচারীকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং ক্ষমতার অপপ্রয়োগকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। #