দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক:
পাটকল শ্রমিক জাহালমকে ঋণ জালিয়াতির ২৬ মামলায় জড়ানোয় তাকে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশ ৩১ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত।
একই সঙ্গে আগামী সাতদিনের মধ্যে জাহালমকে পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করতেও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। পাশাপাশি ব্র্যাক ব্যাংকের করা আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত ও পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আগামী ৩১ অক্টোবর শুনানির জন্য পাঠিয়েছেন চেম্বার জজ আদালত। দুদকের আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম বিষয়টিকে নিশ্চিত করেন।
তিনি জানান, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় বিনা অপরাধে তিন বছর জেল খাটা জাহালমকে সাতদিনের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা দিতে ব্র্যাক ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বারজজ আদালত।
জাহালমকে ৭ দিনের মধ্যে ৫ লাখ টাকা দেওয়ার শর্তে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্য অর্থ পরিশোধ না করা হলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন আদালত।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ব্র্যাক ব্যাংকের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে সোমবার (২৯ আগস্ট) আপিল বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের চেম্বার জজ আদালত এ আদেশ দেন।
আদালতে আজ ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান ও অ্যাডভোকেট আনিসুল হাসান। দুদকের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান।
১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জাহালমকে আসামি করে ঋণ জালিয়াতির ২৬ মামলায় জড়ানোয় তাকে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এক মাসের মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জাহালমকে এই টাকা দিতে বলা হয়।
দুদকের নবীন অনভিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুলে সালেকের বদলে গ্রেফতার করা হয় টাঙ্গাইলের জাহালমকে। তাকে ‘আবু সালেক’ হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন ব্র্যাক ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা। সে কারণে ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এই জরিমানা দিতে বলা হয়।
এর আগে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জাহালমের ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে রুলের শুনানি শেষে যেকোনো দিন রায় ঘোষণা করবেন বলে অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন আদালত। তারই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ বিষয়ে রায় দেন। এরপর চলতি বছরের গত ৭ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ের ৮৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়।
রায়ে ব্র্যাক ব্যাংককে বলা হয়, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার এক মাসের মধ্যে জাহালমকে ওই ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে। আর টাকা দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে তা লিখিতভাবে জানাতে হবে। কিন্তু টাকা না দিয়ে ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের পক্ষে আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান এ আবেদন করেন।
২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘‘৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে: স্যার, আমি জাহালম, সালেক না” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত। প্রতিবেদনটি নজরে আনা হলে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন।
এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা, মামলার বাদীসহ চারজনকে তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। এছাড়া রুলও জারি করেছিলেন আদালত। পরে সংশ্লিষ্টরা হাইকোর্টে হাজির হওয়ার পরে জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ দেন এবং দুদকের কাছে ঘটনার বিষয়ে হলফনামা আকারে জানতে চান। সে আদেশ অনুসারে দুদক হলফনামা আকারে তা উপস্থাপন করেন। আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান জাহালম। তারপর রুলের ওপর শুনানি হয়।
সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১২ সালের এপ্রিলে মোট ৩৩টি মামলা করে দুদক। দুদক তদন্ত করে জানায়, জালিয়াত চক্র সোনালী ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখায় আবু সালেকসহ তিনজনের হিসাব থেকে ১০৬টি চেক ইস্যু করে। চেকগুলো ১৮টি ব্যাংকের ১৩টি হিসাবে ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জমা করে ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ওই ১৮টি ব্যাংকের মধ্যে একটি হলো ব্র্যাক ব্যাংক।
জাহালম নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘স্যার, আমি জাহালম। আমি আবু সালেক না, আমি নির্দোষ।’ আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটির বয়স ৩০-৩২ বছরের বেশি নয়। পরনে লুঙ্গি আর শার্ট। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এ বিচারকের উদ্দেশে তাকে বারবার বলতে দেখা যায়, ‘আমি আবু সালেক না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবু সালেকের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটেন, আদালতে অনবরত হাজিরা দিয়ে যান এই জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক। যে ঘটনার তদন্ত করে দুদক জানায়, জাহালম নিরপরাধ। একই মত দেয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও।#