দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক :
কোরবানি পশুর চামড়া নিয়ে নানা বিপাকে সরকার এবং জনগণ। কিন্তু সুযোগ নিচ্ছেন চামড়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এক সময় এই চামড়া শিল্প অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে কোরবানি পশুর চামড়ার কদর ছিল অনেক বেশি। এই চামড়া ক্রয়ের প্রতিযোগিতায় ছিলেন বড় বড় ট্যানারির মালিক, চামড়া ব্যবসায়ী এবং মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের তৎপরতাও বেড়ে যেতো। কোরবানি পশুর চামড়ার অনেক কদর ছিল।
কিন্ত গত কয়েক বছর যাবৎ কোরবানি পশুর চামড়ার সে কদর আর নেই বললেই চলে। চামড়া নিয়ে মহাবিপাকে পড়তে দেখা যায় মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী এবং কোরবানি দাতাদের। ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী কোরবানি পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ অসহায়,গরীব এবং মাদ্রাসায় পড়াশুনায় নিয়োজিত এতিমদের কল্যানে দান করেন কোরবানিদাতারা। এই চামড়ার দাম না পাবার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের কোটি কোটি অসহায়,গরীব এবং মাদ্রাসার এতিম শিক্ষার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি বছরই কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয়। কিন্তু চামড়া খাতে দেওয়া ঋণ সহসা আদায় হয় না। ঋণ পরিশোধে বিভিন্ন সময় বিশেষ সুবিধাও দেয়া হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। অধিকাংশ চামড়া ব্যবসায়ী ব্যাংকগুলোর থেকে নেওয়া ঋণের অর্থ আর ফেরত দেওয়ার কথা ভুলে যান। ফলে এ খাতে মন্দ ঋণের হার ১০ শতাংশের ওপরে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে চামড়া খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৪১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তিন মাস আগে অর্থাৎ ডিসেম্বর প্রান্তিক এ হার ছিল ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৮৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
এদিকে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্প স্থানান্তর করে মালিকরা আর্থিকভাবে সমস্যায় পড়েছেন। এরপর করোনাসহ নানামুখী সমস্যার কারণে এখন পর্যন্ত সংকট কাটেনি। সাভারে কারখানা প্রস্তুত করতে নগদ অর্থ যা ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে। এখন কাজ করার মূলধন নেই। করোনার কারণে ব্যবসাও খারাপ। সময় মতো ঋণের অর্থ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ফলে ঋণখেলাপি হচ্ছেন অনেকে।
‘সাভারে জমির মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান না হওয়ায় নতুন ঋণও নিতে পারছেন না মালিকরা। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে’— উল্লেখ করে শাহীন আহমেদ আরও বলেন, ‘আমরা জমির মালিকানা সমস্যার সমাধানসহ সরকারের নীতিসহায়তা চাই। যদি নীতিসহায়তা দেওয়া হয় তাহলে নতুন করে চামড়া খাত ঘুরে দাঁড়াবে, পাশাপাশি নতুন ঋণ নেওয়া সহজ হবে। খেলাপি ঋণও কমে আসবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত চামড়া খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে। তাদের বিতরণ করা ঋণরে পরিমাণ ৭ হাজার ১২৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৯ দশমিক ২৩ শতাংশ অর্থাৎ এক হাজার ৩৭০ কোটি ৬০ লাখ টাকা খেলাপি হয়েছে। বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ খাতে ঋণ দিয়েছে ৪ হাজার ৯৫৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা অর্থাৎ ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ খেলাপি। বিদেশি ব্যাংকগুলো দিয়েছে ১৮২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। খেলাপির পরিমাণ ২৪ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্থাৎ ৪৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারমড়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম আবু ইউসুফ বলেন,ঈদুল আজহা উপলক্ষে এবারও কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীদের বিশেষ ঋণসুবিধা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগের দেওয়া ঋণ খেলাপি হলে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে তা পুনঃতফসিল করা যাচ্ছে। তবে, নিয়ম মতো ঋণ পরিশোধ না করায় এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
করোনার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে চামড়া কিনতে যেখানে ৫৫৫ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক, এবার তার অর্ধেকেরও কম ঋণ দিতে চায় তারা। সবমিলিয়ে ২৪৫ কোটি টাকার ঋণ দিতে প্রস্তুত ব্যাংকগুলো। যদিও এ পরিমাণ ঋণ শেষ পর্যন্ত বিতরণ সম্ভব হয় কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সমমানের পণ্য তৈরি করেও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম দাম পাচ্ছেন দেশীয় উৎপাদনকারীরা। শুধুমাত্র কমপ্লায়েন্সের অভাব দেখিয়ে পণ্যের মূল্য কম দিচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
এজন্য ম্যাপিং করে এগোনো দরকার চলতি বছর জনতা ব্যাংক ঋণবাবদ ১২০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। গত বছর একই পরিমাণ অর্থ দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিতরণ হয় মাত্র ৪০ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে ব্যাংকটি দেয় ২০৫ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংক এবার ৩০ কোটি টাকার ঋণ দেবে।
২০১৯ সালে তারা দিয়েছিল ১৫৫ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংক ঋণ দেবে ৭০ কোটি টাকা। করোনার আগের বছর ব্যাংকটি ঋণ হিসেবে দেয় ১৩০ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক এবার ২৫ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। ২০১৯ সালে তারা দিয়েছিল ৭০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, ৯০-এর দশকে বিতরণ করা ঋণের বেশির ভাগ অর্থই ফেরত না আসায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা এবার চামড়া কিনতে তেমন ঋণসুবিধা দিচ্ছে না।
এসকর্ট ফুটওয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহীন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা যতটুকু জেনেছি এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার মতো ঋণ অনুমোদন করেছে। চামড়া কেনার জন্য এই পরিমাণ অর্থ যৎসামান্য। কারণ, কোরবানির সময় পশুর কাঁচা চামড়া কিনতে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। সেখানে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা চাহিদার চেয়ে অনেক কম।’
#