দূরবীণ নিউজ প্রতিনিধি:
কয়লাভিত্তিক তিন বিদ্যুৎ প্রকল্পে শুধু ভূমি ক্রয়, অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে ৩৯০ কোটি ৪৯ লাখ টাকার দুর্নীতির অভিযোগের তথ্য প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
এ তিন প্রকল্পের মধ্যে বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্নীতির পরিমাণ ১৫ কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার, বাঁশখালী এস এস বি্যুৎকেন্দ্রে ২৫৫ কোটি ও মাতারবাড়ী এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্র আত্মসাৎ হয়েছে ১১৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারক এবং মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজশে যথাযথ বিশ্লেষণ না করে প্রভাবশালীদের স্বার্থে কয়লা ও এলএনজি প্রকল্প অনুমোদনের অভিযোগের বিষয়টি তুলেধরেছে টিআইবি।
বুধবার (১১ মে) টিআইবি আয়োজিত ‘বাংলাদেশে কয়লা ও এলএনজি বিদ্যুৎ প্রকল্প : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। টিআইবির সিনিয়র রির্সাচ ফেলো মো. মাহফুজুল হক মো. নেওয়াজুল মওলা গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি জানিয়েছে, ২০২১ সালের ফেব্রæয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের তথ্য-উপাত্ত সংগহ্রকরে গবেষণাপত্র তৈরি করা হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রভাবশালী মহলকে অনৈতিক সুবিধা প্রদানে প্রকল্প অনুমোদন, বিবিধ চুক্তি সম্পাদন, ইপিসি ঠিকাদার নিয়োগ, দি্যুতের দাম নির্ধারণ এবং বিদ্যুৎ ক্রয়ে প্রতিযোগিতা ভিত্তিক পদ্ধতি ব্যবহার না করে বিশেদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গবেষণায় ইজারাকৃত জমি ব্যবহারকারীদের ক্ষতিপূরণ বাবদ বরিশাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থ আত্মসাৎ ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা। আর ক্ষতিপূরণের অর্থ থেকে কমিশন আদায় হয়েছে ৪৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। যা বাঁশখালী এস এস বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫৫ কোটি টাকা।
ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি জবরদখল এবং অর্থ প্রদান না করা ২ কোটি ৪১ লাখ আদায় হয়েছে বরিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে। একই বিদ্যুৎকেন্দ্রে খাস জমির জাল দলিল তৈরি করে তা বিক্রয় বাবদ অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে ১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অপরদিকে বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যক্তিগত জমি ক্রয় ও অধিগ্রহণ বাবদ মূল্য প্রদানে কমিশন আদায় হয়েছে ২০০ কোটি টাকা।
আর মাতারবাড়ী এলএনজি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৮২ কোটি ৫ লাখ টাকা ও একই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যক্তিগত জমির ক্ষতিপূরণের এককালীন অনুদানের টাকা আত্মসাৎ হয়েছে ৩৩ কোটি ও ব্যক্তিগত জমির ক্ষতিপূরণ থেকে এককালীন ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা কমিশন আদায় হয়েছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ২০১০ সালে ৪ বছর মেয়াদে বিশেষ বিধান আইনটি প্রণয়ন করা হলেও উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও ৩ দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২৬ সাল পর্যন্ত আইনটি কার্যকর রাখা হয়েছে। এই আইনের আওতায় পরিবেশ বান্ধব এবং আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী নয়, এমন বড় ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পসমূহ অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।
অপরিকল্পিতভাবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালসহ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়েছে। টিআইবির গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াটের জন্য নির্মাণ ব্যয় সরকারি প্রক্কলন অনুযায়ী ৭-৮ কোটি টাকা হলেও বরিশাল প্রকল্পে ১৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং বাঁশখালীতে ১৬ কোটি ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুমোদন; অতিরিক্ত টাকা সংশ্লিষ্টদের কমিশন হিসেবে গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে।
অথচ পার্শ্ববর্তী দেশে ভারত, চীন, পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ায় নির্মিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদুুতের দাম বাংলাদেশি টাকায় ৩ দশমিক ৪৬ থেকে ৫ দশমিক ১৫ মধ্যে। কিন্তু নির্বাচিত ওই তিন প্রকল্পে বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের সুযোগ রেখে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে বিদুুতের দাম ২২ থেকে ৪৯ শতাংশ বেশি দাম পড়বে।
টিআইবির গবেষণাপত্রে উল্লেখ , জ্বালানি সরবরাহ চুক্তি না করেই প্রতি টন কয়লার প্রাথমিক দাম ১২০ ডলার হিসাব করে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করায় দুর্নীতির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর পর প্রকল্প ব্যয়সহ জ্বালানি মূল্য, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের ওপর নির্ভর করে দাম ইচ্ছামাফিক বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম ২-৩ গুণ বেশি পরার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রভাবশালী বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার- আইপিপি) সরাসরি জ্বালানি আমদানির সুযোগ প্রদানে অনৈতিক চাপ প্রয়োগ ও আইন পরিবর্তন করে রাষ্ট্রীয় জ্বালানি আমদানিকারক প্র্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের ক্ষমতা রহিতকরণ হয়েছে। এর ফলে জ্বালানির দাম ক্রয় মূল্যের চেয়ে অধিক দেখানোর সম্ভাবনা এবং অর্থপাচারের ঝুঁকি রয়েছে।
টিআইবির গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, পার্শ্ববর্তী দেশে নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ০.২৩ একর এবং এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ০.০৫৩ একর জমি গ্রহণ করা হয়েছে। ৩টি বিদ্যুৎ প্রকল্পে শুধুমাত্র ভূমি ক্রয়, অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে মোট ৩৯০ কোটি ৪৯ লাখ টাকার দুর্নীতি হয়েছে।
আত্মসাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এনজিওকর্মী, ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ ও মধ্যস্বত ভোগী। #