নিজস্ব প্রতিবেদক :
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায়, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে চরম মূলধন সংকট তৈরি করেছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক এব গবেষণা প্রতিবেদন এই তথ্য প্রকাশ করেছে টিআইবি। আজ এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
টিআইবর মতে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ৯ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়েছে। অর্থাৎ এই ১০ বছরে খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৪১৭ শতাংশ। টিআইবির মতে, কিছু মানুষের অনিয়ম-দুর্নীতির বোঝা ক্রমাগতভাবে জনগণের উপর চাপানো হচ্ছে।
ঋণ খেলাপি হওয়া এবং তা আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ল তদারকি জোরদার করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান , নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন, গবেষণা টিমের সদস্য ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জুলকারনাইন ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার অমিত সরকার, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ খেলাপিদের অনুকূলে বারবার আইন সংশোধন ও নীতি প্রণয়ন ব্যাংকিং খাতকে ঋণ খেলাপি বান্ধব করেছে এবং খেলাপি ঋণকে প্রাতিষ্ঠানিকী করণ করেছে যা নিয়মিত ঋণ গ্রহীতাকেও খেলাপি হতে উৎসাহিত করছে।
টিআইবি গবেষণার জন্য ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় বিবেচনা করেছে। আর ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ নিয়ন্ত্রণ বিশেষত ঋণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ভূমিকা সুশাসনের বিভিন্ন সূচকের আলোকে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যবসায়িক প্রভাব এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ- যার মধ্যে রয়েছে তদারকি ও নেতৃত্বের সক্ষমতায় ঘাটতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় ঘাটতি এবং তদারকি কাজে সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতি।
গবেষণায় দেখা যায়, সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংকিং খাতে আইনের লঙ্ঘন ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মাধ্যমে সমগ্র ব্যাংকিং খাতে কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপের পরিবারতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব গোষ্ঠী বা পরিবার রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নিজেদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের দখলে নিয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ও বিদেশে অর্থ পাচার জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে ব্যাংকিং খাতের কাক্সিক্ষত ভূমিকাকে ব্যাহত করছে।
খেলাপি ঋণ আদায় না করেই সেপ্টেম্বর ২০১৯ হতে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে মার্চ ২০২০ পর্যন্ত ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। গত জুন ২০২০-এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সমূহের খেলাপি ঋণের কারণে সৃষ্ট মূলধন ঘাটতি মেটাতে ২০১২-১৩ অর্থ বছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ বছর পর্যন্ত সরকার কর্তৃক ১২ হাজার ৪৭২ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হয়।
টিআইবির ১০ দফা সুপারিশ হলো-
১) ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এখাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন করতে হবে;
২) ব্যাংক কোম্পানী আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে;
৩) নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে;
৪) বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে;
৫) ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সকল ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে;
৬) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল গঠন করে সেখান থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে;
৭) রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান করতে হবে এবং ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে;
৮) ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি করণ;
৯ ) প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সাথে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ, পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে;
১০) তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। # প্রেস বিজ্ঞপ্তি