আবুল কাশেম, দূরবীণ নিউজ :
প্রাণঘাতি করোনার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং স্বল্প জনবলকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্ছ রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা নেমেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য কর্মপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে রয়েছেন ‘ প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, উপ প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা, রাজস্ব কর্মকর্তা, এবং আঞ্চলিক কর কর্মকর্তাসহ টপ টু বটম ‘ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
করোনা পরিস্তিতিতে দীর্ঘ ‘লকডাউন, সরকারের ঘোষিত সাধারণ ছুটি, জীবন- মরণের নানা ভয়ভীতি এবং সীমিত জনবল সত্বেও ডিএনসিসিতে ইতোমধ্যে প্রায় ৫১৫ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছেন জানা যায়। তবে দেশের পরিস্তিতি স্বাভাবিক থাকলে এবার বাজেটে ধার্য্য করা টার্গেটের চেয়েও বেশি রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা ছিল বলে জানান কর্মকর্তারা।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিএনসিসির পরিধি বেড়েছে অনেক, বেড়েছে কাজের চাপ। কিন্তু প্রতিনিয়ত কমছে ডিএনসিসির অভিজ্ঞ জনবল। অগ্রানোগ্রামে অনুমোদিত জনবল ৩০৪ জন , বর্তমানে আছে ১৪৩ জন জনবল। আগামী এক বছরের মধ্যে আরো বেশ কয়জন চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। ফলে অভিজ্ঞ জনবলের মারাত্বক সঙ্কটে পড়বে ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগ। রাজস্ব বিভাগের কার্যক্রমে আরো গতিশীল করতে ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির স্বার্থে জনবলের সমস্যা নিরসনের এখনই উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে অভিমত জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
যানা যায়, ডিএনসিসি’র রাজস্ব আয়ের প্রধানতম উৎস রাজস্ব বিভাগ। রাজস্ব বিভাগে ডিএনসিসির ৩৬ টি ওয়ার্ডের আওতাধীন এলাকার বাড়ী-ঘর/ অবকাঠামো/ স্থাপনা সমূহের হোল্ডিং কর, ট্রেড লাইসেন্স ফি, বাজার ভাড়া ও সালামী এবং সম্পত্তি হস্তান্তর কর সহ ১০টি খাত থেকে রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে।
বর্তমানে ডিএনসিসির ৫টি আঞ্চলিক কার্য়ালয়ের মাধ্যমেই রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত কার্যক্রম চলছে। এরমধ্যে উত্তরায় অঞ্চল -১ এ রাজস্ব আদায়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কর কর্মকর্তা মোঃ লিয়াকত আলী মিয়া, মিরপুরে অঞ্চল-২ এ কর কর্মকর্তা মোঃ মিজানুর রহমান , মিরপুরে অঞ্চল-৪ এ, কর কর্মকর্তা মোঃ ছানোয়ার হোসেন, মগাখালী- গুলশানে অঞ্চল-৩ এ কর কর্মকর্তা মোঃ তছলিম উদ্দিন এবং কাওরান বাজারে অঞ্চল-৫ এ কর কর্মকর্তা মোঃ শাহীনুর ইসলাম দেওয়ান।
চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের ১০ টি খাতে গত ২৩ জুন পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণী নিম্মে তুলে ধরা হলো:
১, কর (হোল্ডিং, পরিচ্ছন্ন, লাইটিং) টার্গেট ৪৪০ কোটি টাকা আদায় ২৭৫. কোটি টাকা,
২, বাজার সালামী টার্গেট ১০০.কোটি টার্গেট আদায় ১৯ কোটি টাকা,
৩, বাজার ভাড়া টার্গেট ১০ কোটি আদায় ৭ কোটি টাকা,
৪, ট্রেড লাইসেন্স টার্গেট ১০০ কোটি টাকা আদায় ৫৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা,
৫, রিক্সা লাইসেন্স ফি টার্গেট ৩০ লাখ টাকা আদায় ১১ লাখ টাকা,
৬, প্রমোদ কর টার্গেট ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা আদায় ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা,
৭, সম্পত্তি হস্তান্তর কর টার্গেট ৩০০ কোটি টাকা আদায় ১৫৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা,
৮, নগর কর (City Tax) টার্গেট ১ কোটি টাকা আদায় নাই,
৯, ক্ষতিপূরণ (অকট্রয়) টার্গেট ১ কোটি টাকা আদায় নাই,
১০, বিজ্ঞাপন টার্গেট ১০ কোটি টাকা আদায় ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা,
সর্বমোট টার্গেট ছিল ৯৬৪ কোটি ৮০ লাখ টাকার এরমধ্যে আদায় হয়েছে ৫০৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ডিএনসিসির রাজস্ব আদায়ের হার ৫২.৪৭% ভাগ।
তবে ৩০ জুন পর্যন্ত কর (হোল্ডিং, পরিচ্ছন্ন, লাইটিং) টার্গেট ৪৪০ কোটি টাকা আদায় ২৮৫ কোটি টাকা হতে পারে। একই সাথে ট্রেড লাইসেন্স টার্গেট ১০০ কোটি টাকা আদায় ৫৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা হতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে। অনুরোপ ভাবে অন্যান্য খাতেও রাজস্ব আদায় আরো কিছু বাড়তে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জানা যায়, ডিএনসিসির বর্তমানে পুরনো ৩৬ টি ওয়ার্ড এবং নতুন সম্প্রসারিত-১৮ টি ওয়ার্ড নিয়ে মোট ৫৪ টি ওয়ার্ড। আর এই ৫৪ টি ওয়ার্ড ১৯৭.১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত। ডিএনসিসি আওতাধীন এলাকার রাস্তাঘাট মেরামত, সংস্কার ও উন্নয়ন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশক নিধনসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কার্যত্রম পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা ডিএনসিসি’র নিজস্ব অর্থায়নে সম্পাদন করা হয়। এ সকল কার্যক্রম বাস্তবায়নে ডিএনসিসি বিশাল পরিমান অর্থ প্রতিবছর ব্যয় করে থাকে।
কোভিড-১৯ এর মহামারি প্রাদূর্ভাব থেকে জনগনকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ছিল। এর পর গত ৩১ মে সাধারণ ছুটি প্রত্যাহার করে সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্ব সাশিত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম চলমান রাখার স্বার্থে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত পরিসরে অফিস খোলা রাখার নিমিত্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক নির্দেশনা প্রদান করা হয়। উন্নয়ন কর্মকান্ড চলমান রাখা ও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে সীমিত পরিসরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে রাজস্ব বিভাগ খোলা রেখে আদায় কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে।
ডিএনসিসি নিজস্ব মালিকানা ৪৩টি মার্কেটের মধ্যে ১৩ টি মার্কেট (অবকাঠামোগত জননিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ থাকায়) পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে বাজার ভাড়া গত বছরের তুলনায় কম আদায় হয়েছে। নতুন মর্কেটের সালমী নির্ধারণে সমস্যা থাকায় নতুন বরাদ্দ প্রদান সম্ভব হয়নি। ফলে বাজার সালামী খাতে আদায়ের লক্ষমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
আরো উল্লেখ্য যোগ্য বিষয় হলো; কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগিদের জন্য ডিএনসিসি মহাখালী মার্কেট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমিন বাজার পাইকারী মার্কেটটি প্রকৌশল বিভাগের যান্ত্রিক অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। হযরত শাহ আলী সুপার মার্কেট এবং মিরপুর ১১ নং ডিএনসিসি মার্কেটটি নির্মাণাধীন অবস্থায় আছে। এ পরিস্থিতিতে কাঙ্খিত বাজার সালামী আদায় করা সম্ভব হয়নি।
তাছাড়া, হোল্ডিং কর খাতে ৩২টি মন্ত্রণালের অধীন বিভিন্ন সরকারী /সংস্থার ৬০৭ টি হোল্ডিং এর অনুকূলে ৫৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। উক্ত বকেয়া আদায়ের জন্য ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের স্বাক্ষরিত ডিও পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। নিম্ন ও উচ্চ আদালতে চলমান মামলার কারণে প্রায় ৫৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা বকেয়া পাওনা অনাদায়ী রয়েছে।
এছাড়া নতুন সম্প্রসারিত ১৮ ওয়ার্ড এলাকার রাজস্ব আদায় কার্যক্রমের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে হোল্ডিং কর ধার্যের জন্য সম্ভাব্য ভাড়ার হার (Rate Chart) প্রনয়ন করা হয়েছে। ভাড়ার হার (Rate Chart) কর্পোরেশন সভার অনুমোদনের অপেক্ষমান আছে। অনুমোদিত হলে নতুন সম্পসারিত এলাকার হোল্ডিং কর ধার্য্য ও আদায় কার্যক্রম খুব শিগগিরই আরম্ভ করা হবে। ইতোমধ্যে সম্পসারিত এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (ADB) অর্থায়নে আরবান পাবলিক এন্ড এনভারনমেন্টাল হেলথ সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের (UPEHSP) আওতায় ডিএনসিসি সহ ৭টি সিটি কর্পোরেশনে রাজস্ব বিভাগ এর কার্যক্রম সম্পূর্ণ অটোমেশন করা হচ্ছে।
৫ টি ব্যাংকসহ রকেটের মাধ্যমে অনলাইন পদ্ধতিতে হোল্ডিং কর পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকি সেবা ‘রকেটরে’ মাধ্যমে ৫টি অঞ্চলের হোল্ডিং কর আদায় করা হচ্ছে। রাজস্ব বিভাগের কার্যক্রম সম্পূর্ণ অটোমেশন পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে রাজস্ব বিভাগের কার্যক্রম ও আদায় খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনদুর্ভোগ কম হবে।
এদিকে প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার দপ্তর থেকে জানানো হয়,;
১, করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রাদূর্ভাব প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সরকারি সাধারণ ছুটি থাকায় ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগের হোল্ডিং কর ও ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন কার্যক্রম থেমে যায়।
২, উল্লেখ্য যে, নিয়মানুযায়ী চলতি অর্থ বছরের ৪র্থ কিস্তির পাওনা হোল্ডিং কর ১ হতে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে পরিশোধ করা হলে উক্ত কিস্তির উপর ৫% রিবেট প্রযোজ্য। ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে প্রতি মাসে জরিমানা/ সারচার্জ বাবদ ট্রেড লাইসেন্স ফি এর ১০% বা ১০০ টাকা কম/ বেশি আদায় করা হয়।
৩, চলতি অর্থ বছরের হাল সনের ৪র্থ কিস্তির হোল্ডিং করের উপর ৫% রিবেট এর সুবিধা সম্মানিত করদাতাগণ উদ্ভূত পরিস্থিতে পরিশোধ করতে না পারায় প্রাপ্ত রিবেট সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়েছেন। ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে চলতি অর্থ বছরের হাল সনের এপ্রিল ও মে মাসে প্রচলিত বিধি মোতাবেক জরিমানা আরোপ করা হয়েছে।
৪, (ক) উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড চলমান রাখা ও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে সীমিত পরিসরে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে রাজস্ব বিভাগ খোলা রেখে আদায় কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে।
(খ) হাল সনের ৪র্থ কিস্তির উপর পাওনা হোল্ডিং ট্যাক্স জুন/২০২০ এর মধ্যে পরিশোধ করলে ৫% রিবেট সুবিধা দেয়া যেতে পারে এবং জুন/২০২০ এর মধ্যে উক্ত কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে উক্ত কিস্তির উপর সেপ্টেম্বর/২০২০ পর্যন্ত সারচার্জ মওকুফ করা যেতে পারে।
(গ) জুন/২০২০ এর মধ্যে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করা হলে এপ্রিল- জুন/২০২০ পর্যন্ত ৩ মাসের জরিমানা/ সারচার্জ মওকুফ করা যেতে পারে।
প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল হামিদ মিয়া এবং উপ প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মহসিন আলী বলেন, ডিএনসিসির উন্নয়নের মূলচালিকা শক্তি হলো অর্থ । আর এই অর্থ কালেকশন করেন রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। কিন্তু রাজস্ব কালেকশনের লোকজন না থাকলে, কিভাবে রাজস্ব আদায় বাড়বে। এছাড়ও নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য্য এবং আদায়ের জন্য জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এই দুই কর্মকর্তা বলেন, ওই ১৮ ওয়ার্ড এলাকার রাজস্ব আদায় কার্যক্রমের প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে হোল্ডিং কর ধার্য্যের জন্য সম্ভাব্য ভাড়ার হার (Rate Chart) প্রনয়ন করা হয়েছে। কিন্তু ভাড়ার হার (Rate Chart) ডিএনসিসির কর্পোরেশন সভার অনুমোদন না হওয়ায় , পুরো কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। আরো সমস্য আছে এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করতে হবে। তাহলেই শতভাগ সফলতা আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন রাজস্ব বিভাগের শীর্ষ ওই দুই কর্মকর্তা। # কাশেম