সর্বশেষঃ
বনানীতে ৩ রেস্তোঁরাকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা, ভুয়া ঠিকানায় ট্রেড লাইসেন্স উন্নয়নকাজে সমন্বয়হীনতায় সরকারি অর্থের অপচয় গৃহায়নের প্রকৌশলী আলম ঘুষের দেড় লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার বছিলায় সরকারি খালে নির্মাণাধীন  ৬টি বড় স্থাপনা গুড়িয়ে দিয়েছেন ডিএনসিসির মেয়র ডিএসসিসির ১ ইঞ্চি জমিও আর কেউ অবৈধভাবে দখলে রাখতে পারবে না মেয়র তাপস  RAJUK Employee Management System (REMS)-বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত ডেঙ্গু মোকাবিলা করা বড় চ্যালেঞ্জ : মেয়র আতিকুল ইসলাম শেখ হাসিনাকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ও জর্জিয়ার প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন শিশু আয়ানের মৃত্যু, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রিপোর্ট হাস্যকর : হাইকোর্ট ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০২:১৮ অপরাহ্ন

‘সাবধান ! সামনে ‘করোনার তৃতীয় ঢেউ, সতর্ক না হলে মহাবিপদ’

ডা: তৌহিদ হোসাইন :

“মহামারীর দ্বিতীয় ‘ভাইরাল ওয়েভ’ এখন চলছে। শোনা যাচ্ছে আমরা আরো একটি ওয়েভ তথা তৃতীয় ওয়েভের মুখোমুখী। এ অবস্থা যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনার সংক্রমণ চ্যানেল ব্লক করা এবং দ্রুত টিকা নিয়ে আমাদের শরীরে প্রতিরক্ষা অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমেই করোনা সংক্রমণ থেকে মুক্তি সম্ভব হতে পারে বলে মনে করছেন শেরেবাংলা নগরের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি’র সহযোগী অধ্যাপক ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন।

তিনি মনে করেন, লকডাউন-স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং টিকা কর্মসূচিতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এ মহামারীর ছোবল থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।
প্রশ্ন : বলা হচ্ছে আমরা করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের মুখোমুখি। এভাবে একের পর এক ঢেউয়ের শেষ কোথায়?

ডা: তৌহিদ হোসাইন : ১৮৮৯-৯২ খ্রিষ্টাব্দে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী চলার সময় ভাইরাসের সংক্রমণ চরিত্র পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা প্রথম ‘ভাইরাল ওয়েভ’ শব্দটির প্রয়োগ শুরু করেন। পরে আবার ১৯১৮-১৯১৯ সালে স্পেনিশ ফ্লু ভাইরাস মহামারীর কয়েকটি ভয়াবহ সংক্রমণ ঢেউ প্রত্যক্ষ করার পর থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ‘ভাইরাল ওয়েভ’ শব্দগুলোর প্রয়োগ শুরু করেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঢেউকে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে তুলনা করা যায়।

আমাদের সমাজেও প্রতিনিয়ত যে সাধারণ সর্দি-কাশি হচ্ছে তা একই নিয়মে বছর বছর ফিরে আসে। করোনাভাইরাস প্রথমবার আক্রমণ করার পর তিন-চার মাস স্থায়ী হয়। প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা না হলে সাধারণত দু-তিন মাস পর আবার হানা দেয়। এই অবস্থায় একে দ্বিতীয় ওয়েব বলে। প্রথম ওয়েবের পর দ্বিতীয়-তৃতীয় ওয়েভগুলোর চরিত্র ভিন্নতর হয়। কারণ-পরবর্তী ওয়েভগুলোতে ভাইরাস ক্রমাগত মিউটেশন করতে করতে ভ্যারিয়েন্টে রূপ নিয়ে ভিন্ন প্যাটার্নের হোস্টকে আক্রমণ করে।

সাধারণত করোনা পরীক্ষার নিরিখে শনাক্তের হার একাধারে ১৫ দিন ৫ শতাংশের নিচে থাকলেই করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যায়। সুতরাং দ্বিতীয় ওয়েভ বলতে বুঝায় প্রথমবার করোনা নিয়ন্ত্রণের পর দ্বিতীয়বার আবার নমুনা পরীক্ষার সাপেক্ষে শনাক্তের হার ক্রমাগতভাবে ৫ শতাংশের উপরে উঠে আসা।

প্রশ্ন : সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে তুলনা করা হচ্ছে ‘ভাইরাল ওয়েভ’কে। এটাকে ঠেকানোর উপায় কী?

ডা: তৌহিদ হোসাইন : ‘ভাইরাল ওয়েব’ পুরো সমাজ বা রাষ্ট্রের করোনা সংক্রমণের এমন একটি চিত্র বা প্যাটার্ন যাতে আক্রান্ত রোগীর সংখা ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে একটি চূড়ায় পৌঁছে তারপর একইভাবে আবার নামতে নামতে সংক্রমণের বেজ লাইনের কাছাকাছি চলে আসে। সংক্রমণের এই প্যাটার্নকে যদি কাগজে গ্রাফ আকারে প্রকাশ করি তাহলে তা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দেখায়, তাই একে ‘ভাইরাল ওয়েভ’ বলে।

সমাজে যখন সংক্রমণ শুরু হয়ে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন ভাইরাল ঢেউ উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং রোগী বাড়ার একপর্যায়ে চূড়ায় পৌঁছে যায়। এরপর নামতে থাকে। এটার ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া যায়, যখন ভাইরাল ওয়েভ উঠতে থাকে তখন রোগীর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি রোগীদের রক্তে অ্যান্টিকরোনা অ্যান্টিবডি বাড়তে থাকে, অ্যান্টিজেন বা রোগ জীবাণুর সংখ্যা কমতে থাকে। একটা পর্যায়ে সমাজের বেশির ভাগ রোগীদের শরীরে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে ঢেউয়ের চূড়ায় এসে সেরোকনভার্সনে রূপ নেয়।

এরপর থেকে ঢেউ নামতে শুরু করা মানে করোনা রোগীর সংখ্যা কমতে থাকা এবং সেরে উঠা রোগী তথা সেরোকনভার্সনের রোগী বাড়তে থাকা। এভাবেই ভাইরাল ওয়েভ তার চক্র পূর্ণ করে। পুরোপুরি সেরোকনভার্সন যত দিন থাকবে, তত দিন আবার করোনাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ থাকে না। এ পর্যায়টাকে সেরোলজির ভাষায় সেরোপ্রটেকশন বলি। এই সেরোপ্রটেকশন অবস্থা করোনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ মাস এবং ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে কার্যকর। এরপর এই সেরোপ্রটেকটেড (রক্তে পুরোপুরি অ্যান্টিবডি থাকা) রোগীর তৈরি অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব না থাকার কারণে সেরোরিভার্টেড হয়ে যায় (অর্থাৎ শরীরের অ্যান্টিবডি নিঃশ্বেষ হয়ে যাওয়া)।

ফলে সমাজ ধীরে ধীরে আবারো করোনাক্রান্ত হওয়ার তথা নতুন আরেকটি ‘ভাইরাল ওয়েভে’র ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এইভাবে একটার পর একটা ‘ভাইরাল ঢেউ’য়ের ঝড় মানবসমাজকে নিঃশেষ করে দিতে থাকে এবং ওয়েভ চলতেই থাকে যে পর্যন্ত না ৭০-৮০ শতাংশ লোক আক্রান্ত হয়ে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হয়ে যায়।

স্টাডিতে দেখা গেছে, যারা উপসর্গহীন (৩৫-৪০ শতাংশ) রোগী, তাদের শরীরের রক্তে যে ন্যাচারাল অ্যান্টিবডি (সেরোকনভার্সন) তৈরি হয়, তার স্থায়িত্ব মাত্র তিন-চার মাস এবং অ্যান্টিবডি টাইটারও কম তৈরি হয়। এরপর থেকে তাদের রক্ত থেকে অ্যান্টিবডি উধাও হয়ে যায়। অর্থাৎ সেরোকনভার্সন তখন সেরোরিভার্সনে (রক্তে অ্যান্টিবডি না থাকা) কনভার্ট হয়। ফলে উপসর্গহীন করোনা রোগীরা তিন-চার মাসের মাথায় আবার করোনার ঝুঁকিতে চলে যায়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, তিন-চার মাসের মাথায় ইতঃপূর্বে করোনাক্রান্ত উপসর্গহীন ৩০-৪০ শতাংশ রোগী, উপসর্গযুক্ত ১০ শতাংশ রোগী এবং যারা এখনো করোনাক্রান্ত হয় নাই- সব মিলে সমাজের বিরাট অংশ আবার করোনাক্রান্তের ঝুঁকিতে চলে যায়। ফলে আবার একটি ভাইরাল ওয়েভ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এ জন্য একটা ন্যাচারাল ‘ভাইরাল ওয়েভ’ তিন-চার মাসের বেশি স্থায়ী হয় না এবং একটা নির্দিষ্ট ইন্টারভেলে আরেকটি ‘ভাইরাল ওয়েভ’ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

এত গেল একটা ন্যাচারাল ‘ভাইরাল ওয়েভ’-এর গতি-প্রকৃতির কথা।
কিন্তু মানুষ যখন তার প্রতিরোধের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে চলে এবং পাশাপাশি ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে সমাজকে সুরক্ষা দিতে শুরু করে তখন ‘ভাইরাল ওয়েভ’-এর স্থায়িত্বকাল এবং ইন্টারভেল পিরিয়ডের সময়কালের পরিবর্তন হতে থাকে।

প্রশ্ন : ভাইরাল ওয়েভের মধ্যবর্তী সময় ভিন্ন ভিন্ন দেখা যায়। এর কারণ কি?

ডা: তৌহিদ হোসাইন : করোনার ঢেউ আবার আসবে কি আসবে না কিংবা এলেও কত দিন পরে আসবে এবং কতটুকু ভয়াবহ হবে বিজ্ঞানীদের ভাষায় তা নির্ভর করে নিম্নলিখিত দুইটি মূল ফ্যাক্টরের উপর ১। করোনাভাইরাসের আচরণ ২। সামগ্রিকভাবে মানবসমাজ ও মানব শরীরের প্রতিক্রিয়া (স্বাস্থ্যবিধি মানা, না মানা, সরকার ও জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং টিকা কার্যক্রমের সফলতা)। প্রকৃতিতে লক্ষ করলে বুঝা যায় যে প্রত্যক প্রাণীরই জন্ম, প্রজনন, বেড়ে উঠা, যৌবন কাল এবং মৃত্যু ইত্যাদি সংগঠনের জন্য বছরের বা জীবনের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত আছে।

ভাইরোলজিস্টগন বলেন, ভাইরাস জাতীয় মহামারী একবার যখন আক্রমণে আসে, তখন সবসময় একইভাবে না থেকে বরং নদীসমুদ্রের বহমান ঢেউয়ের মতো আক্রমণ ধারা উঠানামা করে। করোনাভাইরাসও তাই প্রথমবার আঘাত হানার ঠিক তার এক বছরের মধ্যে সে আবার অতিরিক্ত শক্তি নিয়ে একবার কিংবা দুইবার ফিরে আসে। এটাই এই ভাইরাসের চরিত্র। সে হিসেবে বাংলাদেশ অক্টোবর-নভেম্বরে আরো একটি ভাইরাল ওয়েভের মোকাবেলা করতে হতে পারে।

অনেক মহামারীই আছে, প্রথমে যে ঋতুতে আসে, পরের বার আবার ঠিক সেই ঋতুতেই আসে। তাই দেখবেন, গত ২০২০তে যে সময় আমাদের দেশে করোনা হয়েছিল এবারো ঠিক সেই একই সময় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। আমরা কমবেশী স্বাস্থ্যবিধি মানার কারণেই হয়ত ওয়েভটা একটু দেরিতেই এসেছে। এটা অনেকটা বাই ন্যাচার ঘটার মতো ঘটনা। এবারের ঢেউ এসেছে প্রচণ্ড গতিতে এবং গতবারের চেয়ে আলাদা। লক্ষণও ভিন্ন প্রকৃতির।

প্রচণ্ড ও ভিন্ন লক্ষণের কারণ হলো প্রথমবার যখন হানা দেয়, শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভাইরাসকে একভাবে বাধাগ্রস্ত করে; কিন্তু ভাইরাসও তো দমে যাওয়ার পাত্র নয়। তারাও তখন যুদ্ধের নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে আবার মানুষের উপর হামলে পড়ে। মানুষও এবার একা নয়, বরং এবার ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত। এখন মানুষ তার ইমিউন সিস্টেম ও ভ্যাকসিনসহ যুদ্ধে নেমে তাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে।

ভাইরাসও ঘন ঘন মিউটেশন, ভ্যারিয়েন্ট (আলফা,বিটা,গামা, ডেলটা, ডেলটা প্লাস ইত্যাদি) ও স্ট্রেইনে রূপান্তর হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। গত মার্চে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ-আইসিডিডিআরবির এক তথ্যে বলা হয়েছে নতুন আক্রান্তদের ৮১ শতাংশই হলো দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়ান্ট। আবার গত ১৭ জুনে আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বর্তমানে ঢাকার আক্রান্তদের ৬৮ শতাংশ-ই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। এখন দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশের আক্রান্ত রোগীদের ৯০ শতাংশ-ই ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ধরনের।

ইদানীং ভারতে ডাবল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া গেছে। একটি ভাইরাসের মধ্যে যখন দুই ধরনের পরিবর্তন একত্রে মিলিত হয়, তখন সেটিকে ডাবল মিউট্যান্ট বলা হয়। ভারতে ১৩ হাজার নমুনা সিকোয়েন্স করে আটটি রাজ্যে সাড়ে তিন হাজারের বেশি নমুনায় উদ্বেগজনক ডাবল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়ান্ট পাওয়া গেছে। ভারিতীয় করোনা বিশেষজ্ঞরাই এখন বলছেন, অভাগা ভারত এখন বিষময়-বিভীষিকাময় দ্বিতীয় ঢেউ খুব বিশ্রীভাবে মোকাবেলা করে তৃতীয় ওয়েভের গর্তে পা রাখতে যাচ্ছে।

‘ভাইরাল ওয়েভে’র গতি-প্রকৃতির সাথে মানুষের ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটা সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে : যত স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা ও বিলম্বিত ভ্যাকসিনেশন, ভাইরাসের তত নতুন নতুন সংক্রমণের সুযোগ গ্রহণ, যত সংক্রমণ, তত বেশি ভাইরাস মিউটেশন, যত মিউটেশন, তত ভ্যারিয়েন্ট-স্ট্রেইনে রূপান্তর, যত রূপান্তর, তত ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা হ্রাসকরণ, যত ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা হ্রাসকরণ, তত ভয়াবহভাবে ভাইরাল ওয়েভের অবশ্যম্ভাবী পুনরুত্থান, যত ভাইরাল ওয়েভের অবশ্যম্ভাবী পুনরুত্থান, তত বিভীষিকাময় মৃত্যু। এ যেন এক বৃত্ত-সূত্র কাজ করছে। অনেকটা গণিতের সূত্রের মতোই যেন।

প্রশ্ন : বাংলাদেশে এখন দ্বিতীয় ওয়েভ চলছে। আপনি বলছেন অক্টোবর-নভেম্বরে হয়ত তৃতীয় আরো একটি ওয়েভের মুখোমুখি আমরা। কিভাবে আমরা তৃতীয় ওয়েভ থেকে রক্ষা পেতে পারি?

  ডা: তৌহিদ হোসাইন :
২৩ মার্চ, ২০২১ সালে একদল গবেষক এ সংক্রান্ত একটি নিবন্ধে পরিষ্কার একটি গাইডলাইন দিয়েছে। তারা বলছেন করোনার মতো একটি মহামারীর এই ওয়েভের সাথে ১৯১৮-১৯১৯ সালের দেড় বছরব্যাপী এইচ-১ এন-১ ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর ভাইরাল ওয়েভের যথেষ্টই মিল রয়েছে। সেই মহামারীতে নির্দিষ্ট গ্যাপে তিন তিনটি ওয়েভে পুরো মানব জাতিকে কঠিন এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সেই সময়কার ২০০ কোটি লোকের ১৪০ কোটি লোক আক্রান্ত হয়েছিল এবং পাঁচ কোটি লোকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। এর কারণ বিশ্লষণে তারা তখনো কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়া, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধকল কাটিয়ে না উঠতেই এমন একটি মহামারীর হানা, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমন্বয়হীনতা, মহামারী সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকা ইত্যাদিকে দায়ী করেছেন।

কিন্তু বর্তমানে আমরা কোভিড-১৯ সম্পর্কে এ পর্যন্ত যা জানতে পেরেছি, তাতে এ রোগ সংক্রমণ ও প্রতিরোধের একটা মোটামুটি ধারণা পরিস্কার হয়ে গেছে। ভাইরাল ওয়েভের পিক এবং বেজ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তারা ভাইরাল ঢেউ বা ওয়েভের দুই পিকের মাঝের বেজকে বলছেন ‘ইন্টার ওয়েভ স্ট্রলিং পিরিয়ড’ বা ‘ইন্টারমেডিয়েট এন্ডেমিক ফেজ’ এবং ওয়েভের পিকটাকে ‘এপিডেমিক ফেজ’ বলেছেন। এপিডেমিক ফেজে সত্বর শনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসা করার উপযুক্ত সময়।

কিন্তু তাদের মতে, এই ‘ইন্টারমেডিয়েট এন্ডেমিক ফেজ’টাই হলো, আরেকটি করোনা ঢেউ ঠেকানোর উপযুক্ত সময়।
মহামারীর নিয়মানুযায়ী, শিগগিরই আমরা এ পর্যায়ে পৌঁছুতে যাচ্ছি। সে হিসাবে দেশে মহামারীর এই পিরিয়ডই হলো তৃতীয় ঢেউ ঠেকানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

এই সময়ে আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে দ্রুত ভ্যাকসিনেশনের আওতায় নিয়ে আসতে পারি, তাহলে যে তৃতীয় ভাইরাল ওয়েভের আশঙ্কা করছি অক্টোবর-নভেম্বরে, তা ঠেকানো সম্ভব না হলেও দেরি করানো বা এর তীব্রতা কমানো সম্ভব হতে পারে। আর সেটা করতে গেলে শনাক্তকরণ লক্ষ্য মাত্রা ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনাই যথেষ্ট হবে না, বরং ওই বিশেষজ্ঞদের মতে শনাক্তকরণের মাত্রা হতে হবে প্রতি এক লাখ জনে একজন বা তারও কম।

প্রশ্ন : স্বাস্থ্যবিধি কিভাবে মেনে চললে তা কোভিডের বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে?

ডা: তৌহিদ হোসাইন : স্বাস্থ্যবিধি মানা বা না মানার ক্ষেত্রে মানুষের সুবিধাজনক অবস্থান হলো করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়, অন্য কোনোভাবে নয়। সুতরাং এ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে করোনার কেল্লা ফতেহ। আর স্বাস্থ্যবিধি মানার উদ্দেশ্যই হলো করোনাভাইরাসকে এক মানুষ থেকে আরেক মানুষ পর্যন্ত পৌঁছার রাস্তাকে ব্লক করে দেয়া। এটাকে আমরা ‘ত্রিভুজ উৎস’ ব্লক করা বলতে পারি। করোনাক্রান্ত মানুষ- ভাইরাস বহনকারী বাহন- বাহ্যত সুস্থ মানুষ- এই তিন নিয়ে ত্রিভুজ। আরো খোলাসা করে বললে বলতে হয়, ভাইরাসের এ তিনটি উৎস হলো :

করোনাক্রান্ত রোগী (উপসর্গহীন বা উপসর্গযুক্ত), ভাইরাস বাহন (বায়ু, রেস্পিরেটরি ড্রপলেট বা নিউক্লিয়াই, ফোমাইটস) এবং বাহ্যত করোনা অনাক্রান্ত সুস্থ মানুষ। এ তিনটিকে একত্রে আবার চেইন অব ইনফেকশন বলে। রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে এই তিন উৎস পরস্পর আপন ভাইয়ের মতোই হাত ধরাধরি করে চলে।

স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়ন করতে গেলে আমাদেরকে করোনাভাইরাসের এই তিনটি উৎসেই কুঠারাঘাত করতে হবে। এই তিনটি উৎসের সবচেয়ে বড় উৎস হলো করোনাক্রান্ত রোগী। এ পর্যায়ে দ্রুত রোগী শনাক্ত করা, করোনা রোগী আইসোলেট করে তাকে চিকিৎসা করা, করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে রাখা খুবই জরুরি। যত দ্রুত রোগ শনাক্ত করে আইসোলেশন, চিকিৎসা ও কোয়ারেন্টিন করা হবে তত দ্রুত করোনার এই বড় উৎসটি ধ্বংস হবে।

করোনার দ্বিতীয় উৎসটি হলো পরিবেশ অর্থাৎ করোনা রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস, কথাবার্তা, হাঁচি-কাশি থেকে নাক-মুখ নিঃসৃত রেস্পিরেটরি ড্রপলেট (৫-১০০০ মিক্রোমিটার) ও রেস্পিরেটরি এরোসল বা ড্রপলেট নিউক্লিয়াই (১-৫ মিক্রোমিটার) যা আশপাশের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং ফোমাইটস (কাপড়-চোপড় ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্যাদি)।

করোনা জীবাণুর কোনো হাত-পা নেই। এই রেস্পিরেটরি ড্রপলেট, রেস্পিরেটরি এরোসল বা ড্রপলেট নিউক্লিয়াই ও ফোমাইটস-ই হলো করোনাভাইরাসের গাড়ি বা বাহন। পরিবেশের এ অবস্থাটাকে কন্ট্রোল করার জন্য আমাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে, মাস্ক পরিধান করতে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে (৬ ফুট) এবং সর্বদা হাত-মুখ ধুইয়ে নাক-মুখ-চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হয়। আর এ অবস্থাকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার জন্য সরকার কঠোর লকডাউন-শাটডাউন-কারফিউয়ের মতো কঠিন সিদ্বান্ত বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয়।

এই লকডাউন শাটডাউনের কাজটার বাস্তবায়ন অত্যন্ত কঠিন; কিন্তু খুবই ফলপ্রসূ। সর্বস্তরের জনগনের সহযোগিতা ছাড়া সরকারের একার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। আমি তো মনে করি রুটি-রুজি সন্ধানী খেটে খাওয়া মানুষের বিকল্প একটা ব্যবস্থা করে সরকার যদি ১৪ দিনের কঠিন শাটডাউনের চিন্তা করতে পারত, তাহলে আশা করা যায়, সংক্রমণের এই চ্যানেলকে অনেকাংশে ব্লক করে দিতে পারত।

এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের কাছে যা জানা আছে তা হলো, এই রেস্পিরেটরি ড্রপলেট-নিউক্লিয়াই বা ফোমাইটস্ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের মধ্যে করোনা ছড়ানোর রাস্তাও নেই। মুখোমুখি মাস্ক ছাড়া কথা বলা, হাঁচি-কাশি ইত্যাদির মাধ্যমেই মূলত করোনা ছড়ায়। সুতরাং বলা যায় এখানে মানুষ মানুষের যেমন শত্রু, তেমনি বন্ধুও হতে পারে বটে।

তৃতীয় উৎসকে ‘বাহ্যত করোনা অনাক্রান্ত সুস্থ মানুষ’ এ জন্য বললাম যে করোনা মহামারীর এ সমাজে যাকে আপনি সুস্থ্য মনে করছেন, হতে পারে সে উপসর্গহীন করোনা রোগী, যে আপনার-আমার অজান্তেই মানুষ থেকে মানুষে করোনা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

পাঠকদের উদ্দেশ্যে এই দূর্যোগে আপনার পরামর্শ কি?
এই মহাদূর্যোগকে শুধু নিয়তির উপর ছেড়ে দেয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে আমরা যেমন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট, ভাইরাসও তারই সৃষ্ট। এই ভাইরাসই হয়ত আমাদের একটা পরীক্ষা যে এ অবস্থায় কার সাথে কি আচরণ করি।

এত বড় দূর্যোগ সরকারের একার পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। বরং সরকার হল এখানে অনেকটা সমরে উৎসাহিত করা বাদক দলের মত। সরকার সমস্ত শক্তি দিয়ে সাহস দিয়ে আমাদেরকে করোনা যুদ্ধে নামার সম্ভাব্য সব ধরণের সহযোগীতায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, আর জনগণের উচিৎ সরকারের হাতে হাত মিলিয়ে করোনা সৈনিকের ভূমিকা পালন করা।

এখন সময় এসেছে সরকারের এমন কিছু নির্দেশিকা জারির‍ যাতে জনগন বাধ্য হয় টিকা নিতে। যেমন সরকার হয়ত ঘোষণা দিবেন যারা টিকা নিবেন না তাদের জন্য কি কি সরকারী কিংবা বেসরকারী সুযোগ-সুবিধা থাকবে না।
সরকার নির্দেশ জারি করে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত কিংবা সম্ভব হলে সকল নাগরিকের জন্য টিকা গ্রহন বাধ্যতামূলক করে দিতে পারে।

সবশেষে ভ্যাকসিনের বিশ্ব যোগান দাতা COVAX এর দুটি শ্লোগানকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে দোয়া নিতে চাই।
১। “দ্রুত মহামারী বিস্তারকারী এ বিশ্বে অবস্থান করে আমরা একজনও নিরাপদ নই যতক্ষণ না প্রত্যেকেই নিরাপদ হব” (With a fast moving pandemic, no one is safe, unless every one is safe)
২। “একজনও দৌড়ে জিততে পারব না যতক্ষণ না প্রত্যেকেই জিতব” ( No body wins the race, until every one wins)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে ভ্যাকসিন- টক্সিনের এই যুদ্ধে আমাদের হেফাযত করুন।

প্রতিবেদকঃ কলামিস্ট ও স্বাস্থ্য বিষয়ক নিবন্ধকার। সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অফ হিস্টোপ্যাথলজী,ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ কিডনী ডিজিজেস এন্ড ইউরোলজী, শের-ই-বাংলা নগর, ঢাকা।/ কাশেম

#


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published.


অনুসন্ধান

নামাজের সময়সূচী

  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৪:৫৬ পূর্বাহ্ণ
  • ১২:১১ অপরাহ্ণ
  • ৪:২৬ অপরাহ্ণ
  • ৬:১১ অপরাহ্ণ
  • ৭:২৪ অপরাহ্ণ
  • ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

অনলাইন জরিপ

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি এখন লিপসার্ভিসের দলে পরিণত হয়েছে।’ আপনিও কি তাই মনে করেন? Live

  • হ্যাঁ
    25% 3 / 12
  • না
    75% 9 / 12