বিল গেটস বা স্টিভ জোবসের মতো হয়তো একডাকে তাকে চেনেন না সকলে। কিন্তু, গুগ্লের সিইও হিসাবে তার নাম সামনে আসতেই প্রচারের আলোর কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন ৪৩ বছরের সুন্দর পিচাই।
সুন্দর পিচাই ছিলেন ভারতের একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। দেশটির যে প্রতিষ্ঠানের কৃতি স্নাতক ছিলেন, সেটিও বাংলাদেশের দক্ষিণবঙ্গ থেকে মাত্র কয়েকশ’ কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকেই উঠে এসে বনে গেলেন বিশ্বের অন্যতম কর্পোরেট অধীশ্বর। এ যেন অনেকটা ঘরের পাশের ছেলের বিশ্বজয়ের মতোই।
১৯৭২ সালের ১২ জুলাই দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন সুন্দর পিচাই। তার পুরো নাম পিচাই সুন্দররাজন হলেও সুন্দর পিচাই নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। তার বাবা রঘুনাথ পিচাই একটি ব্রিটিশ সংস্থায় বিদ্যুৎ প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতেন। অন্যদিকে তার জন্মের পূর্বে মা লক্ষ্মী পিচাই ছিলেন একজন শ্রুতিলেখক। ছোট এ সংসারে পিচাইয়ের অপর সঙ্গী ছিলো তার ছোট ভাই।
শিক্ষিত পরিবারটি আর্থিকভাবে খুব যে স্বচ্ছল ছিল, তাও বলা যাবে না। দুই রুমের ছোট্ট একটি বাসায় থাকতেন তারা। তবে রাতের বেলা তাকে ঘরের মেঝেতেই শুতে হত। ওদিকে সুন্দর ছিলেন ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী। ছোটবেলায় বাড়ির ল্যান্ডফোনে একবার ডায়াল করা যে কোনও নম্বরই হুবহু মনে রেখে বাবা-মাকে চমকে দিতেন সুন্দর।
ক্রিকেটভক্ত সুন্দর ছিলেন স্কুলের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। মজার ব্যাপার হলো, আজকের বিখ্যাত এ প্রযুক্তিবিদের হাতে তার বাবা-মা কিন্তু ১২ বছর বয়স অবধি কোন মোবাইল ফোন তুলে দেননি।
চেন্নাইয়ের জহর বিদ্যালয়ে শিক্ষার হাতেখড়ির দিন কাটবার পর তিনি ভর্তি হন পদ্ম সেশদ্রি বালা ভবনে। সেখান থেকে অসাধারণ কৃতিত্বের সাথেসঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন সুন্দর।
জয়েন্ট এন্ট্রান্সে তুখোড় ফলাফল করে তিনি সুযোগ পান ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকৌশল বিদ্যাপীঠ আইআইটি খড়গপুরে। সেখানে মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বি.টেক করবার সুযোগ পান তিনি। আইআইটিতে ভর্তির আগেই সফটওয়্যার তৈরিতে ঝোঁক ছিলো সুন্দরের। তার বানানো প্রথম সফটওয়্যারটি ছিলো একটি দাবার গেমের অ্যাপ্লিকেশন। ব্যাচেলরের পাঠ চুকিয়ে আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার বৃত্তি পেলেন সুন্দর।
যুক্তরাষ্ট্রে পা রেখেছিলেন একটা সুপ্ত বাসনা থেকে, তা হলো ক্যালিফোর্নিয়ার প্রযুক্তি-স্বর্গ সিলিকন ভ্যালিকে তিনি পেতে চান নিজ কর্মস্থল হিসেবে। সেই স্বপ্নের দেশের ক্যালিফোর্নিয়ায় জিনিসপত্রের দাম দেখে তার মাথা খারাপ হবার যোগাড়। ব্যাগপ্যাকের দাম কিনা ৬০ ডলার (বাংলাদেশী প্রায় ৫ হাজার টাকা)! ওদিকে ৬ মাস কথা বলতে না পেরে বান্ধবী অঞ্জলিকেও প্রচণ্ড মিস করছিলেন তিনি। যাই হোক, শেষমেশ ভর্তি হলেন স্ট্যানফোর্ডে।
সুন্দরের অধ্যাপক তাকে পিএইচডির জন্য সুপারিশ করলেও সুন্দর পিএইচডি না করে সেখান থেকে ধাতব বিজ্ঞান ও অর্ধপরিবাহী পদার্থবিজ্ঞানের ওপর মাস্টার্স করলেন।
এবার পিএইচডি করতে এসে ড্রপ-আউট হলেন সুন্দর। তারপর সিলিকন ভ্যালিতে অ্যাপ্লাইড ম্যাটিরিয়ালস নামে একটি অর্ধপরিবাহী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী ও প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে চাকরি নেন। বেশিদিন অবশ্য সেখানে টেকেননি সুন্দর। ওদিকে এমএস করতে আমেরিকায় হাজির হয়ে গেলেন সুন্দরের প্রেমিকা অঞ্জলি। তখনই বিয়েটা সেরে নিয়েছিলেন তারা।
এরপর পামার বৃত্তি নিয়ে ২০০২ সালে পেনিসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোয়ারটন স্কুল থেকে এমবিএ করেন তিনি। প্রকৌশলের পর ব্যবসায়ের ওপর ডিগ্রি যার, কারিগরি দিকের বদলে প্রতিষ্ঠানের পণ্য ব্যবস্থাপনায়ই ঝোঁক বেশি থাকার কথা তার। সে ফর্মুলা মেনেই সুন্দর প্রথম চাকরি নিলেন ম্যাককিনসে এন্ড কোম্পানিতে ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে।
২০০৪-এ গুগলপ্লেক্সে তিনি যেদিন প্রথম ইন্টারভিউ দিতে এলেন, দিনটি ছিলো একটু উদ্ভট- এপ্রিল ফুল দিবস! কাকতালীয়ভাবে সেদিনই জিমেইল চালু করে গুগল। সেদিন তিনিসহ অন্যান্য চাকরিপ্রার্থীরাও ভেবেছিলেন মার খেতে যাচ্ছে গুগলের এই প্রজেক্ট! প্রথম দফাতেই চাকরিটা হয়ে গেলো তার। গুগলের সার্চ টুলবার নিয়ে কাজ করবার জন্য গঠনকৃত ছোট একটি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হলে সেখানেই গুগল-যজ্ঞে অভিষেক ঘটে সুন্দর পিচাইয়ের।
টুলবারের গুরুত্বে ২০০৬ সালে হঠাৎ করেই বাধ সাধলো মাইক্রোসফট। ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারে ডিফল্ট করে দেওয়া হলো বিং-কে। তখন নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য নেতিবাচক এ পরিবর্তনের কার্যকরী ফলাফল প্রশমিত করতে কম্পিউটার নির্মাতাদের তিনি সম্মত করলেন তাদের হার্ডওয়্যারে টুলবার প্রি-ইনস্টল করতে। ফিরে এলো টুলবারের রাজত্ব।
গুগলের সার্চ টুলবারের সাফল্যই ছিলো সুন্দর পিচাইয়ের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া মুহূর্ত। কেননা এর মাধ্যমেই তিনি গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ও সার্গেই ব্রিনকে হাত করে ফেলেন। ফলস্বরূপ, সুন্দর কর্তৃক গুগলের নিজস্ব ব্রাউজার তৈরির পরিকল্পনায় সায় দিয়ে দেন তারা। ব্যস, ২০০৮ সালে চলে এলো ‘গুগল ক্রোম’। অল্প সময়েই মাইক্রোসফটের ইন্টারনেট ইক্সপ্লোরার ও মজিলা ফায়ারফক্সকে ছাপিয়ে ব্রাউজারের দুনিয়ায় একক আধিপত্য কায়েম করে ক্রোম।
এর ধারায় পরবর্তীতে ক্রোম সিরিজ হিসেবে বাজারে আসে ক্রোম ওএস, ক্রোমবুকস ও ক্রোমকাস্ট। ক্রোমের কৃতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ সে বছরই পণ্যোন্নয়ন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন সুন্দর। চার বছরের মাথায় ক্রোম ও অ্যাপ বিভাগের জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট বনে যান তিনি।
২০১৩ এর গোড়ায় অ্যান্ড্রয়েডের জনক ও প্রধান অ্যান্ডি রুবিন কর্মস্থল ছাড়লে ল্যারি পেজ সুন্দর পিচাইকে তার স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন। ল্যারি পেজের দূরদৃষ্টি সবথেকে ভালো পড়তে পারতেন সুন্দর পিচাই-ই। গুগলের প্রতি দায়িত্বে তিনি এতটাই নিষ্ঠাবান ছিলেন যে, টুইটার কর্তৃক একাধিকবার ‘লোভনীয়’ সুযোগ হাসিমুখেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। সফলতা ও সততার প্রতিদানস্বরূপ ২০১৪ সালের অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে ল্যারি পেজের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড, অর্থাৎ গুগলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ ‘প্রোডাক্ট চিফ’ পদে অধিষ্ঠিত হন সুন্দর।
প্রিয় এ ভাবশিষ্যকে নিয়ে আপ্লুত ল্যারি পেজ বলেন, ‘সামনে কী হতে যাচ্ছে, তা দেখবার এক অসীম ক্ষমতা আছে সুন্দরের, সেই সাথে আছে একটি বিশাল কর্মীদল ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে সংহত করার দক্ষতা।’
সুন্দরের প্রোমোশনের দিন ঘোষণাপত্রে সুন্দরকে ল্যারি পেজ উল্লেখ করেন ‘পারফেক্ট ফিট ফর দিস রোল’। অনুমিতভাবেই ২০১৫ সালের ১০ আগস্ট গুগলের প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)-ঘোষিত হন সুন্দর।
সিইও হয়ে তার নতুন চ্যালেঞ্জ গুগলের নয়া অবতার অ্যালফাবেট ইনকর্পোরেটেডকে দাড় করানো। গুগল অধীনস্থ সকল কোম্পানি-প্রোডাক্টকে এক সুতোয় গাঁথতে স্বয়ং গুগলই এ নয়া কোম্পানি গড়েছে।
কথায় বলে, লোকের আয়-রোজগার নিয়ে জানতে চাওয়া নাকি শোভনীয় নয়! কিন্তু ব্যক্তিটি যখন গুগলের সিইও, তখন জানার আগ্রহটা তুঙ্গে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। ২০১৬ সালে সুন্দর পিচাই আয় করেছিলেন ১৯৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১,৬৬০ কোটি বাংলাদেশী টাকা), যা ২০১৫ এর আয়ের দ্বিগুণ।
২০১৬-তে তার নির্ধারিত মাসিক বেতন ছিলো সাড়ে ৬ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, এর বাইরেও তহবিল, লভ্যাংশসহ নানা খাত থেকে প্রতি মাসে আরও মোটা অঙ্কই আয় করেন সুন্দর। ২০১৬ সালে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিলো ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এসব তথ্যই ২০১৭-তে প্রকাশিত এবং তা ২০১৬ এর আয়ের ওপর হিসাব করা হয়েছে।
সুন্দর নিজেই স্বীকার করেন, কেবল মেধার জোরে কখনও এতদূর আসেননি তিনি। গুগলে তার চেয়েও তুখোড় মেধাবী অনেকেই রয়েছেন, কিন্তু মানুষের মন বুঝতে পারা, কাজ আদায় করিয়ে নেয়ায় পারদর্শিতাই তাকে সাফল্যের শীর্ষে তুলে এনেছে।
ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, বন্ধুত্বপরায়ণ ও পরোপকারী হিসেবে পরিচিত সুন্দর। তার এসব গুণাবলী এবং পেশাগত জীবনে তার অবদান ও গত দুই বছরের ঘটনাবলী সিলিকন ভ্যালির অন্য সিইও-দের তুলনায় অনন্য অবস্থানে রাখবে গুগল নির্বাহীকে।
ব্যক্তিজীবনে সুন্দর
আইআইটিতে পড়াকালীন প্রেম করেছিলেন যার সাথে, তাকে বিয়ে করে আগেই সফল প্রেমিকের খাতায় নাম লেখানো সফল কর্মজীবী সুন্দর এখন এক কন্যা ও এক পুত্রের জনক। তার সাফল্যমণ্ডিত উত্থানে স্ত্রীর রয়েছে বিশাল অবদান। মাইক্রোসফট, ইয়াহু ও টুইটারে মোটা অঙ্কে সিইও হবার অফার পেয়েও গুগলে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত সুন্দর নিয়েছিলেন স্ত্রী অঞ্জলির অনুপ্রেরণাতেই।
ইনস্টাগ্রামে তো একেবারেই নয়, টুইটারেও অনেক কম সক্রিয় সুন্দর পিচাই। কেবল গুগল প্লাসে কিছুটা সময় দিয়ে ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষর সেখানেই ফেলেছিলেন সুন্দর পিচাই।
ব্যক্তিজীবনে খুবই মিতভাষী সুন্দরকে একনজর দেখলে কিছুটা গোবেচারা এবং একইসাথে রাশভারী মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, বন্ধুত্বপরায়ণ ও পরোপকারী হিসেবেই কাছের লোকদের কাছে পরিচিত। তিনি এখনও প্রায়ই ভিডিও কনফারেন্সে নিজের আইআইটি খড়গপুরের জুনিয়রদের সাথে কথা বলেন। কর্পোরেট দুনিয়ার একটি বাজে দিক হচ্ছে ভোগবাদিতার চূড়ান্ত ব্যাকরণ মেনে চরম স্বার্থপরতা। সুন্দর পিচাই মিতভাষী হয়েও গা বাঁচানো কূটনীতি না করে স্বার্থবাদের ঊর্ধ্বে উঠেই সবসময় কথা বলেন। যে কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও অভিবাসন ইস্যুর মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও মুখ খুলেছেন তিনি।
সুন্দর পিচাই সম্পর্কে কিছু তথ্য
গভীর চিন্তায় ডুবে গেলে পায়চারি করতে থাকেন সুন্দর। মিটিং-এর মাঝেও কোন বিষয়ে গভীর মনোনিবেশের প্রয়োজন হলে ঘরভর্তি লোকের মাঝেই পায়চারি করে বেড়ান তিনি।
নিজের হাইস্কুলের ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। এখনও পাঁড় ক্রিকেট ভক্ত হিসেবে পরিচিত।
শোনা যায়, ইয়াহুর CEO মারিসা মেয়ারের সঙ্গে দেখা করতে পিচাই তার অফিসের বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন, কাজ আদায় না হওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত দেননি।
পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সুন্দর পিচাইয়ের নীতি বেশ কড়া। তার অফিস সারাক্ষণ থাকে ঝকঝকে-তকতকে, ছিমছাম।
যে কোনও নাম্বার একবার শুনলেই বহুদিন মনে রাখতে পারেন পিচাই। কারও ফোন নাম্বার লিখে রেখে বা সেইভ করে রাখার প্রয়োজন পড়ে না তার!
সুন্দর পিচাইকে একনজর দেখলে কিছুটা গোবেচারা এবং রাশভারী মনে হলেও ব্যক্তিজীবনে তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, বন্ধুত্বপরায়ণ ও পরোপকারী হিসেবে পরিচিত। তিনি এখনও প্রায়ই ভিডিও কনফারেন্সে নিজের আইআইটি খড়গপুরের ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে কথা বলেন, পরামর্শ দেন, সহযোগিতা করেন।