নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটের অগ্নিকাÐের বিশালতা ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষিতে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন নগর এলাকার সেমিফর্মাল তথা উপানুষ্ঠানিক মার্কেটসমূহের অগ্নিঝূঁকিসহ সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি)’ বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার (৮এপ্রিল) আইপিডি অনলাইনে আয়োজিত “বঙ্গবাজারে অগ্নিকাÐ এবং উপ-আনুষ্ঠানিক মার্কেটের অগ্নিঝুঁকি: আইপিডি’র পর্যবেক্ষণ” শীর্ষক অনুষ্ঠানে এই বেশ কিছু পরামর্শসহ এসব অভিমত ব্যক্ত করেন আলোচকগণ।
আইপিডি’র পক্ষ থেকে নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড.আদিল মুহাম্মদ খান মূল প্রবন্ধে বলেন, বঙ্গবাজার মার্কেট অগ্নিকাÐের জন্য অত্যন্ত ঝূঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র নোটিশ দিয়েই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ তথা সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস দায়মুক্ত হয়েছে।
আইপিডি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, রাজধানী ঢাকা সহ সারাদেশের উপানুষ্ঠানিক মার্কেটের বিশদ জরিপের মাধ্যমে ফায়ার কোড ও বিল্ডিং কোড অনুযায়ী অগ্নিঝূঁকি নিরসনে করণীয়সমূহ সুনির্দিষ্ট করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মার্কেটসমূহ অগ্নি সুরক্ষার জন্য তদানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে না পারলে আইন ও বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। ক্রেতারা সুলভে পণ্য কিনতে পারেন বিধায় দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় উপানুষ্ঠানিক মার্কেটের প্রয়োজনীয়তা আছে। যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এ ধরনের মার্কেটের অগ্নি ঝূঁকি অনেকটা কমানো সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে মার্কেটের মালিক, ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীদের আন্তরিক ভ‚মিকা পালন করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পরিকল্পনাবিদ আবু তাহের বলেন, এ ধরনের মার্কেটের জন্য ইলেকট্রিক্যাল সেফটি অডিটিং এর পাশাপাশি অগ্নি প্রতিরোধ ও ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেমকে উন্নত করা প্রয়োজন। একইসাথে প্রতিটি মার্কেটে ফায়ার কন্ট্রোল রুম স্থাপনের পাশাপাশি ফায়ার সেফটি প্ল্যান ও জরুরি নির্গমন প্ল্যান থাকা জরুরি। নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, প্রতিটি বিপণী বিতানের ফায়ার ও ডিজাস্টার ভালনারেবিলিটি এসেসমেন্ট করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ রেদওয়ানুর রহমান বলেন, নগরের বিপনী বিতানসমূহকে অগ্নিঝূঁকি অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস করে সাধারণ মানুষকে যথাযথভাবে অবগত করবার মাধ্যমে সামাজিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধিও জরুরি।
আইপিডির বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যমান অগ্নি নির্বাপণ আইন, বিল্ডিং কোড ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি উপানুষ্ঠানিক মার্কেটসমূহের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও মার্কেটসমূহের ডিজাইন স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়ন করা জরুরী। একইসাথে অগ্নিঝূঁকিতে থাকা বিপণি বিতানসমূহের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাযথ নির্দেশনার পাশাপাশি সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা দরকার। ঝূঁকিপূর্ণমার্কেটসমূহকে যথাযথ নোটিশ দেবার পাশাপাশি অগ্নি নির্বাপণ আইন অনুসারে ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থাসমূহকে আইন ও বিধি ধারা নির্ধারিত ভ‚মিকা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। পাশাপাশি বিপণী বিতানের মালিক, ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীদেরকে সরকারী সংস্থাসমূহ ও সংশ্লিষ্ট আইনের নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালন করতে হবে। নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় যথাযথ ভ‚মি ব্যবস্থাপনা, ভবনের অনুমোদিত ব্যবহার ও দূর্যোগ প্রতিরোধে পুকুর-জলাশয়-জলাধার সংরক্ষণ করা দরকার। নগর এলাকায় অগ্নি নির্বাপণের জন্য ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের আশু উদ্যোগ নিতে হবে।
জনগণের জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে মার্কেটের স্বত্বাধিকারী হিসেবে সিটি করপোরশনের দায়িত্ব ছিল মার্কেটের অগ্নি নিরাপত্তার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা নেয়া। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতা এবং উদাসীনতারও দায় আছে, যা দোকান মালিক সমিতি ও ব্যবসায়ীরা কোনভাবেই এড়াতে পারেনা। ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরশনের পক্ষ থেকে ২০১৭ সাল থেকে দশবারের মত নোটিশ দেবার পরও এই মার্কেটে অগ্নিকাÐ প্রতিরোধের যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের নগর ব্যবস্থাপনা ও আইনের শাসনের ভংগুর ও ক্ষয়িষ্ণু বাস্তবতার পরিচয় বহন করে। এই অবস্থার লাগাম টানা না গেলে আগামী দিনগুলোতে নগর এলাকার মার্কেট-বিপণীবিতান কিংবা বহুতল ভবনে অগ্নিকাÐ সহ এই ধরনের বিপর্যয় আরো বাড়তে থাকবে।
আইপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, ফুলবাড়িয়া খেলার মাঠকে মার্কেটে রূপান্তর করা ছিল ঐতিহাসিক ভুল। নগর এলাকায় এভাবে অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে মাঠ কিংবা জলাশয় কোন কিছুকেই রক্ষা করা যাচ্ছেনা। সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে উসমানী উদ্যানের জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে শুকিয়ে ফেলা হয়েছে, পুরান ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন নগর এলাকায় পুকুর-জলাশয় নির্বিচারে ভরাট চলছে, যা নগর দূর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির শংকা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে ফেলছে।
উপানুষ্ঠানিক মার্কেটসমূহের অগ্নিঝূঁকি কমাতে ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইপিডির পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাবনা দেয়া হয়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল — মার্কেট ও বিপণীবিতানের অভ্যন্তরীণ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা; ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা; ঘনবসতিপূর্ণ, সংকীর্ণ রাস্তা ও অপরিকল্পিত নগর এলাকার জন্য ফায়ার সার্ভিসের বিশেষায়িত ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা; অগ্নি নিরাপত্তাকর্মীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা; মার্কেটর ফায়ার ও দূর্যোগ স্বেচ্ছাসেবী তৈরি এবং ফায়ার সেফটি কমিটি ও ফায়ার সেফটি প্ল্যান তৈরি; নিয়মিত ফায়ার ড্রিল বা মহড়া আয়োজন প্রভৃতি। ব্যবসায়ী ও নগর সংস্থাসমূহের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধের জায়গা তৈরি হলে উপানুষ্ঠানিক মার্কেটসমূহকে নিরাপদ করে অর্থনীতিতে তাদের কার্যকর অবদান নিশ্চিত করা সম্ভবপর বলে মনে করে আইপিডি। # কাশেম