দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক:
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় উল্লেখ করা আয় , স্থাবর অস্থাবর সস্ম্পদ, ঋণ -দায় এবং দেনার বিবরণী কতোটা সঠিকতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। উল্লেখিত পর্যাপ্ত আয় ও সম্পদ কতোটা বৈধ উপায়ে অর্জিত তা যাচাইয়ের সুযোগ থাকলেও তা যাচাই বাছাই করা হচ্ছে না।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত১৫ বছরে মন্ত্রী, এমপি এবং নেতাদের পরিমান অস্বাভাবিক বেড়েছে। এরমধ্যে মন্ত্রী/ প্রতিমন্ত্রীদের ৫ বছরে আয় সর্বোচ্চ বেড়েছে ২ হাজার ১৩৪ শতাংশ, একই সময়ে ৫ বছরে সম্পদ বেড়েছে ১ হাজার ৬৩ শতাংশ এবং ১৫ বছরে বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫০ শতাংশ।
মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল‘নির্বাচনী হলফনামায় তথ্যচিত্র, জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে ব্যবসা ও রাজনীতি একাকার হয়ে গেছে। যেটা রাজনীতি সেটাই ব্যবসা, যেটা ব্যবসা সেটাই রাজনীতি হয়ে গেছে। রাজনীতিতে যারা আসেন তারা অনেকেই ব্যবসার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন, ব্যবসায়ীরা রাজনীতে প্রবেশের মাধ্যমে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন। যার ফলে অনেক সিদ্ধান্ত, অনেক আইন, নীতি পরিবর্তন জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে করা হয়েছে, এটা বলা কঠিন।
টিআইবি’র আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশননের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলমের স্বাক্ষরে গণমাধ্য পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়। এরমধ্যে আরো বলা হয়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বশেষ তিনটি ও আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক কোটিপতি প্রার্থী অংশগ্রহণ করছেন। অর্থাৎ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোটিপতি প্রার্থীদের প্রাধাণ্য দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে নবম নির্বাচনে কোটিপতি প্রার্থী ছিলেন মাত্র ২৭ শতাংশের কিছু বেশি। সেটি ১৫ বছরের ব্যবধানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ শতাংশে। এদিকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করা প্রার্থীদের প্রায় ৪৭ শতাংশই কোটিপতি। হলফনামায় আরো দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রার্থীর নামেই বড় আকারের (সর্বোচ্চ ৮১৩ একর) ভূমির মালিকানা রয়েছে। অথচ, দেশের আইন (ল্যান্ড রিফর্ম অ্যাক্ট-২০২৩) অনুযায়ী একজন ব্যক্তির ভূমির মালিকানা পাওয়ার সর্বোচ্চ সীমা (কৃষি জমির ক্ষেত্রে ৬০ বিঘা এবং অ-কৃষি জমি সহ যা ১০০ বিঘা পর্যন্ত যেতে পারে)। এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রায় ২৭ শতাংশেই ঋণ বা দায় আছে। যার মোট পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। হলফনামার তুলনামূলক হিসাবে দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যদের কারো কারো আয় সর্বোচ্চ ২ হাজার শতাংশের বেশি বেড়েছে। ৫ বছরে এমপিদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আয় বৃদ্ধির হার ২ হাজার ২৩৮ শতাংশ এবং ১৫ বছরে এই হার ৭ হাজার ১১৬ শতাংশ। একইভাবে, ৫ বছরে এমপিদের সর্বোচ্চ সম্পদ বৃদ্ধির হার ৫ হাজার ৪৭০ শতাংশ। ১৫ বছরে এই হার ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৩ শতাংশ। মন্ত্রী/ প্রতিমন্ত্রীদের ৫ বছরে আয় সর্বোচ্চ বেড়েছে ২ হাজার ১৩৪ শতাংশ, একই সময়ে ৫ বছরে সম্পদ বেড়েছে ১ হাজার ৬৩ শতাংশ এবং ১৫ বছরে বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫০ শতাংশ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রার্থীদের দাখিল করা হলফনামায় নিজেদের অর্জিত সম্পদ কতোটা দেখিয়েছেন, পুরোটা দেখিয়েছেন কি-না কিংবা দেশে বা বিদেশে সম্পদ আহরণের তথ্য গোপন করেছেন কিনা- তা যাচাই যেমন অনিবার্য, তেমনি যে আয় ও সম্পদ অর্জনের তথ্য হলফনামা বিশ্লেষণে পাওয়া যাচ্ছে তা বৈধ আয়ের সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ- এ বিষয়সমূহ যাচাইসাপেক্ষে জবাবদিহি নিশ্চিতের কোনো উদ্যোগ নেই বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে । নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও রাজস্ব বিভাগ প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে স্বপ্রণোদিত হয়ে সেগুলো যাচাইয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করবে- এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে।
টিআইবি’র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “হলফনামায় প্রার্থী পরিচিতি” বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ ও “নো ইউর ক্যান্ডিডেট” ড্যাশবোর্ড উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে টিআইবির পক্ষ থেকে এ মন্তব্য করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম, সহসমন্বয়ক ও ড্যাশবোর্ড প্রস্তুতকারী রিফাত রহমান এবং কে. এম. রফিকুল আলম। প্রতিবেদন উপস্থাপনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সমন্বয়ক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
টিআইবি’র বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল প্রার্থীর হলফনামায় দেওয়া শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা ও আয়ের উৎস, মামলার বিবরণী, প্রার্থীর নিজের ও তার নির্ভরশীলদের আয়-ব্যয়, সম্পদ ও দায়-দেনা এই আট ধরণের তথ্যকে বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করেছে টিআইবি। প্রতিবেদনের পাশাপাশি ইন্টারঅ্যাকটিভ ড্যাশবোর্ডটিও তৈরি করা হয়েছে। ড্যাশবোর্ডের লিংক: https://www.ti-bangladesh.org/kyc এর মাধ্যমে সর্বশেষ চারটি জাতীয় নির্বাচনের অংশগ্রহণকারী সকল প্রার্থীর সার্বিক, আসন ও দলভিত্তিক তুলনামূলক চিত্র দেখা যাবে। ড্যাশবোর্ডটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন ভোটারগণ ঘরে বসেই নিজ এলাকার প্রার্থী সম্পর্কে তথ্য ও তুলনামূলক চিত্র পাবেন, অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ স্ব স্ব এখতিয়ার অনুযায়ী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তথ্যের বহুমুখী বিশ্লেষণের সুযোগ নিতে পারবে।
টিআইবি’র প্রতিবেদনে দেখানো হয়, সর্বশেষ তিনটি ও আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দ্বাদশ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশগ্রহণ করছেন। কোনো দলই তিনশ আসনে প্রার্থী দেয়নি, তবে শতভাগ আসনেই কমপক্ষে এক বা অনেক ক্ষেত্রে একাধিক প্রার্থী হয় ক্ষমতাসীন দলের সদস্য বা সমর্থনপুষ্ট। প্রার্থীদের অর্ধেকের বেশিই প্রায় ৫৭ শতাংশই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৩.৬৬ শতাংশ প্রার্থী স্বশিক্ষিত। সর্বশেষ তিনটি ও আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ৫৭ শতাংশ ব্যবসায়ী প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। গত ১৫ বছরে ব্যবসায়ী প্রার্থীদের অংশগ্রহণের হার বেড়েছে ১০ শতাংশ। অন্যদিকে, বছরে ১ কোটি টাকা আয় করেন এমন প্রার্থীর সংখ্যা এবার সর্বোচ্চ ১৬৪ জন। তবে কোটি টাকার কম আয় করে এমন প্রার্থীর হার ৬৫.৩ শতাংশ। এবার প্রায় ২৭ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি (অস্থাবর সম্পদ মূল্যের ভিত্তিতে)। শতকোটিপতি প্রার্থী সংখ্যায় ১৮, সর্বোচ্চ কোটিপতির প্রদর্শিত সম্পদমূল্য ১ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।
টিআইবি’র বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তবে হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য পর্যাপ্ত কিনা বা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা যায়, টিআইবির প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী, সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ রয়েছে, যার প্রতিফলন হলফনামায় নেই। মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনও বিদেশে সক্রিয়ভাবে রিয়েল এষ্টেট ব্যবসা পরিচালনা করছেন। যে সকল কোম্পানির মোট সম্পদ মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।
হলফনামায় উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে মন্ত্রী ও এমপিদের অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘হলফনামায় উঠে আসা সকল তথ্যই সঠিক কি-না, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেননা যেভাবে সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে হলফনামায় সম্পদের হিসাব প্রকাশ এক ধরনের দায়সারা গোছের আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। হলফনামায় মিথ্যা বা অপর্যাপ্ত তথ্য প্রকাশ করা, আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে যে সকল প্রতিষ্ঠানের এ সব বিষয় খতিয়ে দেখার কথা, তারাও এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে।
অন্যদিকে, যে আয়, ঋণ ও সম্পদ অর্জনের তথ্য হলফনামায় প্রদান করা হয়েছে, বিশেষ করে যে রূপ অবিশ্বাস্য মাত্রায় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীগণের অনেকেরই সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে তা বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি-না এবং তা না হলে জবাবদিহি নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ না থাকা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। এক্ষেত্রে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বপ্রণোদিত ভূমিকা পালনের যথেষ্ট সুযোগ ও অপরিহার্যতা রয়েছে। তাই টিআইবির ড্যাশবোর্ড থেকে তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দুদক, এনবিআর, নির্বাচন কমিশনসহ সকল অংশীজন তাঁদের কর্তব্য নির্ধারণ করবেন- এই প্রত্যাশা করছি। বিশেষ করে, এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলসমূহের সামনে যে আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা দলসমূহের কাছে যথাযথ গুরুত্ব পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’
এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রার্থীদের সম্পদ বৃদ্ধির হার খুবই ভয়াবহ বলে মনে হচ্ছে। আমরা দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারিনি। অথচ একটা শ্রেণি এতটাই সম্পদশালী হয়েছে যে ভাবলে হতবিহ্বল হয়ে পড়তে হয়ে। অন্যদিকে একটি বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠী দিন-আনে-দিন খায় অবস্থাতেও নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো এটা না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যে রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করছে, তাদের সময়ই তো আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে সরে গেলাম। গুটিকয়েক মানুষের উন্নয়ন হয়েছে-অথচ আমরা শুধু বলে বেড়াচ্ছি আমাদের উন্নয়ন হয়েছে। অল্প সংখ্যক মানুষের আগ্রাসী ভূমিকার অধীনে আমরা চলে গিয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই এই গুটিকয়েক মানুষ তাদের স্বার্থের বাইরে কাজ করছে না।’ # প্রেস বিজ্ঞপ্তি