দূরবীণ নিউজ প্রতিনিধি:
নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে জড়িয়ে পড়েছেন হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালকসহ ‘টপ টু বটম’ কর্মকর্তারা। গণমাধ্যমে প্রায় হোমল্যান্ড লাইফের কর্মকর্তাদের নানা অপকর্ম এবং গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু এসব দেখার দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রশাসনের রহস্যজনক নিরবতা সুযোগে এই প্রতিষ্ঠানটি ডুবতে বসেছে।
এদিকে নিরুপায় হয়ে রোববার (৫ মার্চ) হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের গ্রাহকদের ১০৪ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা দ্রæত তদন্ত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে ১৪ গ্রাহকের পক্ষে রহিমা আক্তার নামের এক ভিকটিম হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদন দায়ের করেছেন।
রিট আবেদনে বিবাদী করা হয়েছে,অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ), দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান, হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ এই প্রতিষ্ঠানটির ১৪ পরিচালককে। এই রিটকারীদের পক্ষে মামলাটি শুনানি করবেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, তার সঙ্গে থাকবেন অ্যাডাভোকেট আব্দুল্লাহিল মারুফ ফাহিম, আক্তার রসুল মুরাদ ও মো. দিদারুল আলম দিদারসহ সিনিয়র আইনজীবীগণ।
রিট আবেদনে হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাতের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রæত তদন্ত ও অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে রুল জারির আবেদন জানানো হয়েছে। পাশাপাশি গ্রাহকদের পাওনা টাকা দ্রæত ফেরতের বিষয়ে নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য,গত ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘পরিচালকদের প্রতারণার খপ্পরে হোমল্যান্ড লাইফ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্টে এ রিট আবেদনটি দায়ের করা হয়েছে। পত্রিকার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লন্ডন প্রবাসী সিলেটের পরিচালকদের একটি গ্রæপের প্রতারণার খপ্পরে পড়ে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে সিলেটেই হতো পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক।
অপরদিকে ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালকদের মধ্যে ১২ জন পরিচালক যৌথ স্বাক্ষরে লিখিতভাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যানের দপ্তরে ওই প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত নানা অনিয়ম, দুর্নীতি এবং বিপুল পরিমান অর্থ লোপাটের অভিযোগ দায়ের করেন।
পরিচালকরা অভিযোগের শুরুতেই উল্লেখ্য করেছেন , হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, আইন কর্মকর্তা ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তারা সকল ধরনের গ্রাহক লেনদেনে সম্পৃক্ত। বীমা গ্রাহক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শেয়ারহোল্ডাদের স্বার্থে কোম্পানির বিভিন্ন বিষয়ের প্রকৃত চিত্র বের করতে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্তের দাবিও জানিয়েছেন।
আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের কাছে দায়ের করা আবেদন পত্রে স্বাক্ষর করেছেন হোমল্যান্ড লাইফের ভাইস চেয়ারম্যান জামাল মিয়া, পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক, কামাল মিয়া, আবদুর রব, জামাল উদ্দিন, আব্দুল হাই, আব্দুল আহাদ, ফয়জুল হক,শামীম আহমদ,এমাদুল ইসলাম, স্বতন্ত্র পরিচালক শওকতুর রহমান ও ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী। উক্ত আবেদনের অনুলিপি অর্থমন্ত্রী এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবরও পাঠিয়েছেন।
তারা অভিযোগ বলেছেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় হোমল্যান্ড লাইফের কেনা ১২০ কাঠা জমি গ্রাহকের দাবি পরিশোধে বিক্রয় করা হয়। কিন্তু সঠিকভাবে সম্পূর্ণ টাকা গ্রাহকের দাবি পরিশোধে ব্যয় করা হয়নি। গ্রাহকের টাকা পরিশোধ না হওয়ায় পরিচালকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা পর্যন্ত হয়েছে।
কয়েকজনের দুর্নীতির জন্য এই পরিচালকরা অসম্মানিত হয়েছেন উল্লেখ করে আবেদনে ( চিঠিতে) বলা হয়েছে, কোন কোন এরিয়ায় কোন কোন গ্রাহককে কত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, তার তালিকা এবং জমির বিক্রয়মূল্য সঠিকভাবে নির্ণয় করা হয়েছে কি না? জমি ক্রয় এবং বিক্রয়ে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না বা একজন ব্যক্তির (পছন্দের ব্যক্তি) মাধ্যমে কেন সম্পূর্ণ জমি বিক্রয় করা হয়, তা তদন্তের মাধ্যমে দেখা দরকার।
অভিযোগে বলা হয়েছে, জীবন বীমা তহবিল হ্রাস পাওয়ার সঠিকতা নির্ণয় এবং বর্তমান কোম্পানির জীবন বিমা তহবিল কত তা উপস্থাপন করা হয়নি। আবার কোম্পানির কতগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে এবং বিগত পাঁচ বছর সব ব্যাংকের বিবরণী এফডিআর, বাংলাদেশ সরকারি টেজারী বন্ড (বিজিটিবি)সহ উপস্থাপন করা হয়নি।
কোম্পানির যেসব মামলা চলমান তার বিবরণ এবং প্রত্যেক মামলার বিপরীতে মামলার শুরু থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আইনজীবী ফি, দাপ্তরিক ও টিএ/ডিএ এবং অন্যান্য খরচ যৌক্তিক ভাউচার ছাড়াই এমডি, কোম্পানি সচিব ও আইন কর্মকর্তা জুবায়েরের স্বাক্ষরে বিপুল টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পরিচালকরা। একে ‘কোম্পানির টাকা কর্মচারী কর্তৃক আত্মসাৎ’ বলে মনে করছেন ওই পরিচালকরা।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, তথ্য আড়াল করে নিয়মবহির্ভূত অনেক টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। গত দুই বছরের বিভিন্ন ব্যয়ের বিপরীতে যে ভাউচার আছে, সেগুলো ওই সময়ের ব্যাংক স্টেটমেন্টের সঙ্গে যাচাই করলে জনগণের আমানত খেয়ানত করার প্রমাণ বের হয়ে আসবে।
এছাড়া আরজেএসসি-তে রিটার্ন জমা দেওয়ার দাপ্তরিক ও লিগ্যাল ফি বাবদ কত টাকা খরচ করা হয়েছে তার হিসাবের বৈধতা না থাকায় বিবরণী বোর্ডে পেশ করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন এই পরিচালকরা।
তাদের অভিযোগ, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভুয়া শত শত কোটি টাকা ব্যবসা দেখিয়ে কমিশন, ইনসেনটিভ গ্রহণ ও কোম্পানির টাকায় ওমরাহসহ বিদেশ ভ্রমণ করে কোম্পানির অর্থ অপচয় করা হয়েছে। এ কারণে সঠিক পলিসি গ্রাহক অর্থের সংকটে সেবা পেতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। ভুয়া ব্যবসা বা পলিসির জন্য নবায়ন প্রিমিয়াম না আসায় কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। #