দূরবীণ নিউজ ডেস্ক :
বিদেশ থেকে দামি ব্রান্ডের আমদানি করা সিগারেটের কন্টেইনারে মিষ্টি ভুট্টা, বেকিং পাউডার, গাড়ির টায়ার ও রুটি মেকারের ঘোষণা দিয়ে দামি সিগারেটের চালান খালাস সরকারের কোটি কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি এবং আত্মসাতের চা ল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছে দুদক কর্মকর্তারা।
সূত্র মতে, নানা কৌশলে ’জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় একটি শক্তিশালী চক্র সরকারের কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে নিজেরা লাভবান হচ্ছে বলে চা ল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে ওই চক্রটি এনবিআর’র অ্যাসাইকুড়া ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে প্রবেশ করে আমদানিকৃত ২২টি সিগারেটসহ উচ্চ শুল্কের চালান খালাসের মাধ্যমে সরকারের ২১১ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে।
ওই সব চালান আটকে থাকার পর কোৗশলে এনবিআরের অ্যাসাইকুড়া ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে ঢুকে অবৈধভাবে ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল থেকে ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে খালাস করা হয়েছে। এই চক্রটি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে বদলি হওয়া দুই কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ডের অপব্যবহার করে বিভিন্ন পণ্যের নামে আনা সিগারেটের এসব চালান খালাস করেছে।
এই জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপ পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে সাত সদস্যের টিম কাজ করছেন। তাদের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে কমিশন গত ২ মার্চ ১৪টি মামলার অনুমোদন দিয়েছে। মামলায় ১৪ আমদানিকারক ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট ৫৪ জনকে আসামী করা হয়েছে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে মামলাগুলো দায়ের করা হবে বলে জানা গেছে।
জানা যায়,এর আগে একই ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ২০১৯ সালের বিভিন্ন সময়ে ২১টি মামলা দায়ের করেছিল। যা পরবর্তীতে পুলিশের সিআইডিকে তদন্তভার দেওয়া হয়। পরে আদালতের নির্দেশনায় ২০২১ সালের সিআইডি থেকে তদন্তভার দুদকের কাছে হস্তান্তর হয়। এরপর শুরু হয় দুদকের পুনরায় অনুসন্ধান।
সূত্র মতে, দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ২০১৩ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা ছিলেন ডি এ এম মহিবুল ইসলাম। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. ফজলুল হক ২০১৩ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত কাস্টম হাউসে কর্মরত ছিলেন। তাদের বদলি করার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ন্ত্রিত অ্যাসাইকুড়া ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড অপব্যবহার করে ৩ হাজার ৭৯৭ বার লগইন ও লগআউট করা হয়। এর মাধ্যমেই বিভিন্ন পণ্যের নামে আনা দামি সিগারেটের ২২টি চালান খালাস করা হয়। রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয় ২১০ কোটি ৮২ লাখ ৯০ হাজার ৮১০ টাকার।
এ ঘটনার সাথে ১৪টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জড়িত রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- আর কে ইন্টারন্যাশনাল, মুভিং ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জারার এন্টারপ্রাইজ, সিফাত ট্রেডিং, এস ডি ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল, জাহিদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এস কে এস এন্টারপ্রাইজ, খান এন্টারপ্রাইজ, মিমি লেদার কটেজ, এ কিউ ট্রেডিং, সুপার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এইচ এল ট্রেড কর্পোরেশন, এস পি ইন্টারন্যাশনাল ও এস এ এম (স্যাম) ইন্টারন্যাশনাল।
সূত্র মতে, আর কে ইন্টারন্যাশনালের মালিক বিথী রানী সাহা ২০১৮ সালে সিটি ব্যাংক লিমিটেডের ইসলামপুর রোড শাখায় হিসাব খুলে ভারত থেকে বিভিন্ন এক্সেসরিজ আমদানির জন্য ২০ শতাংশ মার্জিনে ১১ হাজার ৯০৪ মার্কিন ডলার মূল্যের ঋণপত্র খোলেন। এলসির বিপরীতে সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট মো. মিজানুর রহমান চাকলাদারের মালিকানাধীন এম আর ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেন।
কিন্তু এক্সেসরিজের কথা বলে সিগারেট আমদানি করায় তার পণ্যের খালাস কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তখন অ্যাসাইকুড়া ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে চালানটি ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল লক করা হয়। কিন্তু বদলিকৃত রাজস্ব কর্মকর্তা ডি এ এম মহিবুল ইসলামের ইউজার আইডি এবং পাসওয়ার্ডের অপব্যবহার করে সিস্টেমে অবৈধভাবে ঢুকে লক অবমুক্ত করে অসাধু চক্র। এরপর ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এক্সেসরিজ বলে আমদানি করা ৬৬ লাখ শলাকা সিগারেট খালাস করা হয়।
সূত্র মতে, দুদকের অনুসন্ধানে পন্য খালাসের কাজে মো. আবুল কামাল নামের একজনের মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী প্রোগ্রামার কামরুল হকের জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। পণ্য ছাড় করতে জাল অনাপত্তিপত্র প্রস্তুত ও ইস্যু ডেসপাচ এবং বিতরণের সাথে রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহম্মদ, কম্পিউটার অপারেটর ফিরোজ আহমেদ, উচ্চমান সহকারী মো. আব্দুল্লাহ আল মাছুম ও অফিস সহায়ক মো. সিরাজুল ইসলামের জড়িত রয়েছেন। ওই জাল কাগজপত্র যাচাই না করে চালানটি শুল্কায়ন করেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইফুন্নাহার জনি ও রাজস্ব কর্মকর্তা মো. হাবিবুল ইসলাম।
চালানটিতে ৪০ ফুট কন্টেইনারে নিট ওজন ছিল ১৪ হাজার ৮৮০ কেজি। ওই চালানে আমদানি নীতি আদেশ লঙ্ঘন করে ঘোষণা বহির্ভূত উচ্চ শুল্কযুক্ত বেনসন অ্যান্ড হেজেস ব্রান্ডের ৬৬ লাখ শলাকা সিগারেটে খালাস নেওয়া হয়েছে। এসব সিগারেট খালাস করতে আদায়যোগ্য শুল্ক-করের পরিমাণ ছিল ৮ কোটি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ১০০ টাকা। অথচ সিগারেটকে এক্সেসরিজ পণ্য হিসেবে দেখিয়ে রাজস্ব পরিশোধ করা হয়েছে মাত্র ১১ লাখ ১৯ হাজার ৩১২ টাকা। অর্থাৎ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৮ কোটি ৮ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৯ টাকা। একইভাবে অপর একটি বিল অব এন্ট্রি’র মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণায় ১৬ কোটি ১৬ লাখ ১৪ হাজার ৫১৬ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দ’ুটি চালানে মোট ২৪ কোটি ২৪ লাখ ৩৯ হাজার ৩০৪ টাকা ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় ১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- আর কে ইন্টারন্যাশনালের মালিক হচ্ছে বিথী রানী সাহা, সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট এম আর ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. মিজানুর রহমান চাকলাদার, মো. আবুল কামাল, চট্টগ্রাম কাস্টম অফিসের সহকারী পোগ্রামার কামরুল হক, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইফুন্নাহার জনি, রাজস্ব কর্মকর্তা মো. হাবিবুল ইসলাম, রাজস্ব কর্মকর্তা (এআইআর) সুলতান আহম্মদ, কম্পিউটার অপারেটর ফিরোজ আহমেদ, উচ্চমান সহকারী মো. আব্দুল্লাহ আল মাছুম ও অফিস সহায়ক মো. সিরাজুল ইসলাম।
একই প্রক্রিয়ায় চক্রটি দু’টি চালানে ২০১৮ সালের ২৪ মে থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত জিপার ও চাইনিজ টায়ারের বদলে মিথ্যা ঘোষণায় উচ্চ শুল্কযুক্ত সিগারেট আমদানি ও খালাস করে মোট ১৬ কোটি ১৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭৫০ টাকা ফাঁকি ও আত্মসাৎ করা হয়েছে।
আমদানিকারক সিফাত ট্রেডিংয়ের মালিক মো. সালাউদ্দিন টিটো এবং সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট মো. হাবিবুর রহমান (অপু) চাকলাদার একই প্রক্রিয়ায় তিনটি চালানে মিথ্যা ঘোষণায় সিগারেট খালাস করে ৩২ কোটি ২৭ লাখ ১ হাজার ৬৪৬ টাকা ফাঁকি দিয়েছে। এস ডি ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনালের ব্যানারে ভুট্টা ও বেকিং পাউডার ঘোষণা দিয়ে সিগারেট আমদানিতে ৮ কোটি ১৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬৩৩ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। মেসার্স জাহিদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. জাহিদুল ইসলাম ভুট্টা ও দই ঘোষণা দিয়ে বিলাসী সিগারেট আমদানি করে ৮ কোটি ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯০০ টাকার শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়েছে।
মেসার্স এস কে এস এন্টারপ্রাইজের মালিক রাসেদুল ইসলাম কাফি রুটি মেকারের ঘোষণা দিয়ে সিগারেট আমদানির মাধ্যমে ৮ কেটি ১৫ লাখ ৬ হাজার ১১৩ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। মেসার্স খান এন্টারপ্রাইজের মালিক রাশেদুল হোসেন খান এবং মেসার্স পাবনী এন্টারপ্রাইজের মালিক রাশেদ খান, মো. রুহুল আমিন ও মো. আরিফুর রহমান ৮ কোটি ১৮ লাখ ৫৬ হাজার ৯০৪ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন।
মিমি লেদার কটেজের নামে মিথ্যা ঘোষণা ৮ কোটি ১৮ লাখ ৫ হাজার ১৮৪ টাকা, এ কিউ ট্রেডিংয়ের নামে ৮ কোটি ১৪ লাখ ৯৮ হাজার ৫১ টাকা, মেসার্স সুপার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে ৮ কোটি ১১ লাখ ৭ হাজার ৯৭৪ টাকা, এইচ এল ট্রেড কর্পোরেশনের নামে ৮ কোটি ১৩ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৯ টাকা, মেসার্স এস পি ইন্টারন্যাশনালের নামে ৮ কোটি ১৭ লাখ ৭০ হাজার ৮৫২ টাকা এবং আমদানিকারক এস এ এম (স্যাম) ইন্টারন্যাশনাল ৮ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার ৮৫৫ টাকা শুল্ক-কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে মিথ্যে ঘোষণায পণ্য খালাসের অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ইউজার আইডিতে ব্যবহার করা দুই মোবাইল ফোন নম্বর মালিককে আসামি করে ৬ মামলা অনুমোদন দেয় দুদক। এ ৬ মামলার অন্যান্য আসামিরা হলেন- মিমি লেদার কটেজের মালিক গোলাম মোস্তফা, সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট মোফাজ্জেল হোসেন মোল্লা। আমদানিকারক এ কিউ ট্রেডিংয়ের মালিক আব্দুস কুদ্দুস রায়হান এবং সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট ইকবাল হোসেন মজুমদার।
আমদানিকারক মেসার্স সুপার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক রবীন্দ্রনাথ সরকার এবং সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট হাবিবুর রহমান চাকলাদার (অপু)। আমদানিকার এইচ এল ট্রেড কর্পোরেশনের মালিক আব্দুল হান্নান দেওয়ান। মেসার্স এস পি ইন্টারন্যাশনালের মালিক মোহাম্মদ সেলিম এবং সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট লাবনী এন্টারপ্রাইজের মালিক রাশেদ, রুহুল আমিন ও আরিফুর রহমান। সি অ্যান্ড এফ এজেন্ট লাবনী এন্টারপ্রাইজের তিন মালিক এবং আমদানিকারক এস এ এম (স্যাম) ইন্টারন্যাশনালের মালিক সেফায়েত উল্লাহ। #