ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী আরমানকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। আজ রোববার ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে তাদের আটক করা হয়।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সম্রাট ও তার সহযোগী আরমানকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের মুখপাত্র সারওয়ার-বিন-কাশেম। তাকে আজই আদালতে তোলা হবে বলে জানান এ র্যাব কর্মকর্তা।
জানা যায়, দেশব্যাপি ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে গা ঢাকা দেন সম্রাট। এর মধ্যে তিনি দেশ ছাড়ার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা চালালেও তা ভেস্তে যায় আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতায়। কুমিল্লা থেকে গ্রেফতারের আগে তিনি ঢাকায় এক প্রভাবশালী নেতার বাসায় আত্মগোপন করে ছিলেন। সে বাসা থেকে বেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সীমান্ত এলাকায় এসেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সীমান্তবর্তী গ্রাম কুঞ্জুশ্রীপুর থেকে গ্রেফতার করা হয় সম্রাটকে।
জুয়া ক্যাসিনো ছাড়াও ঢাকা দক্ষিণের গোটা অঞ্চলে ছিল তার দাপট। গত ১০ বছর ধরে চাঁদাবাজি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বাড়ি ও জমিদখল সবই নিয়ন্ত্রণ করেছেন সম্রাট।
ফেনীর পরশুরাম উপজেলার অধিবাসী সম্রাটের পিতা রাজউকের ছোট পদে চাকরি করতেন। বাড়ি পরশুরামে হলেও সেখানে তাদের পরিবারের কেউ থাকেন না। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকাতে বড় হন সম্রাট। পরিবারের সঙ্গে প্রথমে বসবাস করতেন কাকরাইলে সার্কিট হাউস সড়কের সরকারি কোয়ার্টারে।
১৯৯০ সালে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে রাজনীতির জীবন শুরু করেন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। সারাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। সম্রাট রমনা অঞ্চলে আন্দোলনের সংগঠকের দায়িত্বে ছিলেন। এ কারণে তখন নির্যাতনসহ জেলও খাটতে হয় তাকে। এরপর থেকেই ‘সম্রাট’ খ্যাতি পান সাহসী সম্রাট।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সবশেষ কাউন্সিলে তিনি যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি নির্বাচিত হন। আগের কমিটিতে তিনি ছিলেন একই ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক। দক্ষিণ যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা মিল্কীর হত্যাকাণ্ডের পর সম্রাটের আর পিছু তাকাতে হয়নি। মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল, বাড্ডা এলকায় অপরাধ জগতের একক আধিপত্য তৈরি করেন সম্রাট। তিনি ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের সঙ্গে মিলে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্রাটের ঘনিষ্ঠ দুই সহচর হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। যুবলীগের অপর প্রভাবশালী নেতা জিকে শামীমও সম্রাটকে অবৈধ আয়ের ভাগ দিতেন।
১৯৯১ সালে ছাত্রলীগে থাকা অবস্থায় এরশাদের পতনের পর ক্ষমতায় আসে বিএনপি সরকার। সে আমলে সম্রাটের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। ১/১১-এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সময় সম্রাট যুবলীগের প্রথমসারির নেতা ছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসে। এরপর থেকেই রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হতে থাকেন সম্রাট। দলীয়ভাবে পদোন্নতিও হয় তার। আওয়ামী লীগের বড় বড় অনুষ্ঠানে পরিচিত মুখ হিসেবে উপস্থিত থাকতেন। সম্প্রতি ক্যাসিনো চালানো, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ সব অভিযোগের তীর এখন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের দিকে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি রাজধানীর মতিঝিলসহ দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার সরকারি দফতর, ক্লাবসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্রাটের বড় ভাই বাদল চৌধুরী ঢাকায় তার ক্যাসিনো ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। ছোট ভাই রাশেদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। তার বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মা বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর সম্রাটের পরিবারের সবাই গা ঢাকা দেন। সম্রাট থাকতেন মহাখালীর বাসায়। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গত কয়েক দিন ধরে তিনি বাসায় ছিলেন না।
‘ক্যাসিনো সম্রাট’ রাজধানীর জুয়াড়িদের কাছে বেশ পরিচিত নাম। সম্রাটের নেশা ও ‘পেশা’ জুয়া খেলা। তিনি একজন পেশাদার জুয়াড়ি। প্রতি মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুরে যান জুয়া খেলতে। সেখানে টাকার বস্তা নিয়ে যান তিনি।
সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকেও আসেন জুয়াড়িরা। কিন্তু সেখানেও সম্রাট ভিআইপি জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত। প্রথম সারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার বিশেষ ব্যবস্থাও আছে।
এয়ারপোর্ট থেকে মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনো পর্যন্ত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিলাসবহুল গাড়ি ‘লিমুজিন’যোগে। সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলতে গেলে সম্রাটের নিয়মিত সঙ্গী হন যুবলীগ দক্ষিণের নেতা আরমানুল হক আরমান, মোমিনুল হক সাঈদ ওরফে সাঈদ কমিশনার, সম্রাটের ভাই বাদল ও জুয়াড়ি খোরশেদ আলম।
উল্লেখ্য, গেল মাসে চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগের কারণে যুবলীগ নেতা সম্রাটের নাম আলোচনায় আসে। অভিযানে যুবলীগ, কৃষক লীগ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা র্যাব ও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। কিন্তু সম্রাট ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযান শুরুর প্রথম তিন দিন তিনি দৃশ্যমান ছিলেন। ফোনও ধরতেন। এরপরই তিনি গা ঢাকা দেন। দেশত্যাগের চেষ্টাও করেন।
১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকায় ক্লাবগুলোতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে র্যাব। প্রথম দিন ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান চালায় র্যাব। এরপরই গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ক্লাবটির সভাপতি খালেদ হোসেন ভুঁইয়াকে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজনৈতিক অঙ্গনের লোকেরা মনে করেন, ঢাকায় ক্যাসিনো ব্যবসার অন্যতম নিয়ন্ত্রক সম্রাট।
অভিযান শুরুর পর গত ২২ সেপ্টেম্বর সম্রাটের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাসংক্রান্ত একটি আদেশ দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোতে পাঠানো হয়। তাঁর ব্যাংক হিসাবও তলব করা হয়।