দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক :
সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক দৃঢ়তাকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশ সমুন্নত রেখে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব বলেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বি.আই.পি.) সংলাপে অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২১ উপলক্ষে বি.আই.পি’র উদ্যোগে আজ শনিবার (১৯ জুন) দুপুরে অনলাইন প্লাটফর্মে ‘বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধারে পরিকল্পনা’ শীর্ষক একটি পরিকল্পনা সংলাপে বিশেষজ্ঞরা এই অভিমত প্রদান করেন।
সংলাপে অংশ নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মোঃ মাকসুদ হাশেম বলেন, পরিবেশ রক্ষায় গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ব্যর্থতার মূলে রয়েছে সমন্বয়হীনতা ও পরিকল্পনাকে বুঝতে না পারা। বিভিন্ন সময়ে গৃহীত নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা গুলোর মালিকানা না থাকায় সেই পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন ও হয়না।
এছাড়াও বিভিন্ন শহরের গৃহস্থালি বর্জ্য পানির ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক আলাদা না করার ফলে নদী খালের পানি দূষিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকার নদী খাল রক্ষায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এর বিশেষ পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
সংলাপে বি.আই.পি.-র সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে পরিকল্পনা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত পরিবেশগত বিপর্যয়ের প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
সংলাপে বলা হয়, সাম্প্রতিককালে মানব সভ্যতার উন্নয়নের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্রমাবনতি সকল প্রাণের অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, পরিবেশ সম্পর্কিত অসচেতনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও সুষ্ঠ নজরদারিরি অভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন নগর-গ্রামীণ ও আঞ্চলিক এলাকায় বিপন্ন হচ্ছে প্রাণ প্রকৃতি এবং ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশকে ধ্বংস করে উন্নয়ন টেকসই হতে পারেনা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক দৃঢ়তা থাকলে পরিবেশ-প্রতিবেশকে সমুন্নত রেখে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব।
বি.আই.পি.-র গবেষণায় জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান ধবংসের কারণ বিশ্লেষণের জন্য পরিবেশগত বিপর্যয়ের ১০০ টি কেইস স্ট্যাডি সমীক্ষা করা হয়েছে, যার মধ্যে পানি দূষণ (৪২), বায়ু দূষণ (২৯), মাটি দূষণ, বৃক্ষ নিধন (১৭), প্লাস্টিক দূষণ (৮) ও অন্যান্য দূষণ (৮) নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়।
পরিবেশগত বিপর্য্য়ের ঘটনাসমূহ পর্যালোচনার মাধ্যমে বি.আই.পি.-র সমীক্ষায় পরিলক্ষিত হয় যে, পরিবেশ ও প্রতিবেশ দূষণের শতকরা ৭০ ভাগ ঘটনার ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায় আছে, শতকরা ৫০ ভাগ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের দায় পরিলক্ষিত হয়।
অনুরূপভাবে এ ধরনের পরিবেশ দূষণের ঘটনা বিশ্লেষণে নগর কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে ৫০%, শিল্প কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ও পণ্য উৎপাদন কারী প্রতিষ্ঠান ৫০%, বনবিভাগ ৩০%, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ৬০% ও জনগণের উদাসীনতার ৪০% ক্ষেত্রেই দায় রয়েছে।
উপস্থাপিত প্রতিবেদনে পরিবেশ দূষণের কারণগুলো পর্যালোচনার মাধ্যমে পানি, বায়ু, মাটি, শব্দ ও প্লাস্টিক দূষণের পেছনে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, আবর্জ্যনা ব্যবস্থাপনার অভাব, অনিয়ন্ত্রিত ইটিপি বিহীন কলকারখানা স্থাপন, অবৈধ ইটভাটার আধিক্যতা, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই বিভিন্ন শিল্প কারখানা, ইটভাটা ও বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী কার্যক্রম পরিচালনা, বন উদ্যান এর গাছ কেটে ফেলা সহ নানাবিধ পরিবেশগত বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরেন ড. আদিল।
পরিবেশ বিপর্যয় এবং নানাবিধ বিরুপ প্রভাবের প্রেক্ষাপটে পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন পরিকল্পনা নীতিতে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের গুরুত্ব তুলে ধরে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক বলেন, আন্তরিক সদিচ্ছা থাকলে বিদ্যমান পরিকল্পনা এবং আইন-নীতিমালার অনুসরণ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়েই আমাদের ভৌত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব ।
বি.আই.পি.-র সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, পরিবেশের প্রতি আমাদের সংবেদনশীল হতে হবে এবং পরিবেশের প্রতি যত্নশীল থেকে উন্নয়ন কর্মকান্ড চালাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, উন্নয়ন সংক্রান্ত সকল নীতিমালায় পরিবেশের বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে এবং পরিবেশ নিয়ে ভূল সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেই আমাদের পরিকল্পনা ও উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বলে মত দেন বি.আই.পি.-র সভাপতি।
খুলনা সিটি কর্পোরেশন এর প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা আবির-উল-জব্বার বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেন। একই সাথে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মহা পরিকল্পনার অভাব এবং সাধারণ জনগণের অসেচতনতা আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পরিবেশ রক্ষায় খুলনার খাল পুনরুদ্ধার চেষ্টা, খেলার মাঠ, পার্ক, উন্মুক্ত স্থান বৃদ্ধি, প্রতিবছর গাছ রোপন, জ্বালানী হিসেবে ফসিল ফুয়েলের ব্যবহারকে নিরুসাহিত করে সোলার সিস্টেম কে উৎসাহিত করার সাম্প্রতিক উদ্যোগের কথাও বলেন এই পরিকল্পনাবিদ।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এর টাউন প্ল্যানার আজমেরী আশরাফী রাজশাহী নগরের পরিবেশ রক্ষায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকটি তুলে ধরে তিনি বলেন, পানি দূষণ রোধে সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ড্রেনেজ পরিকল্পনা, বায়ু দূষণ রোধে ৪২ শতাংশ ভূমিকে কৃষি জমির জন্য বরাদ্দ রাখা এং প্রতিটি সংস্থাকে তাদের কার্যক্রমে বৃক্ষ রোপনে উদ্বুদ্ধ করা এবং ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যার কারণে রাজশাহী শহরে পরিবেশ এর মানদণ্ডে ভাল অবস্থানে আছে।
এছাড়াও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সকল সংস্থা ও সকল স্তরের মানুষকে একাত্ম করা অত্যান্ত জরুরী বলেও তিনি মন্তব্য করেন। মহাপরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সকলের কাছে পৌঁছাতে পারলেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হয় বলে মন্তব্য করেন এই পরিকল্পনাবিদ।
# প্রেস বিজ্ঞপ্তি