দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক:
এবার নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ নৌযান সার্ভে (ফিটনেস পরীক্ষা) ও রেজিস্ট্রেশন শাখায় নানা অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার লাগাম টেনে ধরতে দুদকের পরামর্শে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। একইসাথে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তদন্তে চার সদস্যের প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেনার প্রেক্ষিতে মহাপরিচালক গত ৩১ ডিসেম্বর এই অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. মনজুরুল কবীরকে আহ্বায়ক করে গঠিত চার সদস্যের কমিটি গঠন করেন। কমিটির অপর তিনজন হলেন একই সংস্থার ‘ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার’ মো. ওবায়েদ উল্লাহ ইবনে বশির, নটিক্যাল সার্ভেয়ার এন্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন কাজী মুহাম্মদ আহসান ও প্রসিকিউটিং অফিসার বেল্লাল হোসাইন।
প্রথম ধাপে দুর্নীতির অভিযুক্ত নৌ- অধিদপ্তরের ঢাকা (সদরঘাট) অফিসের ‘ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার’ মো. মাহবুবুর রশিদ মুন্না (সাবেক সার্ভেয়ার, খুলনা) এবং নারায়ণগঞ্জ অফিসের ‘ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার’ মো. শাহরিয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই কমিটিকে তদন্তপূর্বক মতামত ও সুপারিশসহ ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
আগামী ১১ জানুয়ারি সোমবার বিকাল ৪টায় তলব করেছে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির সামনে অভিযুক্তদের লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনের কথা রয়েছে।
জানা যায়, এসব কর্মকর্তা ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত এসেছে খোদ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে। গত ৯ নভেম্বর দুদকের মহাপরিচালক ও অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটির আহ্বায়ক এ কে এম সোহেল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নৌ-সচিবকে জানানো হয়, ‘প্রাপ্ত অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানোর জন্য দুদকে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে।
উক্ত সিদ্ধান্ত অনুসারে বিধিমতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিযোগের ছায়ালিপি প্রেরণ করা হলো’। দুদকের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্তের জন্য নৌ মন্ত্রণালয় গত ১৩ ডিসেম্বর নৌ অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেয়।
জানা যায়, অভিযোগে তিনজন শিপ সার্ভেয়ার ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ অফিসের শিপ সার্ভেয়ারের অনিয়ম-দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে সেখানকার হেড ক্লার্ক আনিছুর রহমান ও পিয়ন মামুনুর রহমানের নাম থাকলেও অধিদপ্তরের এ সংক্রান্ত অফিস আদেশে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সার্ভেয়ার ছাড়া অন্যদের নাম নেই।
দুদকে করা লিখিত অভিযোগে বলা হয়, অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও বরিশাল কার্যালয়ের সার্ভেয়াররা সব কর্মদিবসে কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকেও নিয়ম লঙ্ঘন করে কাগজে-কলমে নৌযান সার্ভে করছেন। নৌযান সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশনে সার্ভেয়ারদের নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা না দিলে হয়রানির শিকার হতে হয়।
তবে দালাল মারফত যোগাযোগ করলে নৌযান পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন সনদ পাওয়া যায়। এভাবে এ তিন কর্মকর্তা প্রতি মাসে প্রায় এক কোটি টাকা করে আয় করছেন।
নারায়ণগঞ্জের সার্ভেয়ার শাহরিয়ার হোসেন সম্পর্কে অভিযোগে বলা হয়, তিনি ঢাকা থেকে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জে অফিস করেন। একদিনও দুপুর ২টার আগে সেখানে যান না এবং বিকাল ৫টার পরপরই কর্মস্থল ত্যাগ করেন। অথচ সর্বোচ্চ ৩-৪ ঘণ্টা কর্মস্থলে থেকেও প্রতিদিন গড়ে ১০টি নৌযান সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন করছেন; মাস শেষে এই সংখ্যা হয় ৩০০।
অভিযোগবেলা হয়েছে, শাহরিয়ার হোসেনকে এসব কাজে সহযোগিতা করেন অধিদপ্তরের সাবেক এক সার্ভেয়ার। অবসর গ্রহণের পর এই সার্ভেয়ার মতিঝিলে একটি অফিস ভাড়া নিয়েছেন, যেখানে বসে তিনি মালিকপক্ষের কাছ থেকে সার্ভে ও নিবন্ধনের জন্য নৌযানের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের পিয়ন মামুনুর রহমান প্রতিদিন বিকালে এসে সেসব কাগজপত্র নিয়ে যান এবং সার্ভেয়ার শাহরিয়ার পরদিন দপ্তরে বসে সেসব কাগজে স্বাক্ষর করেন।
এই সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ- যেসব মালিক নৌযান সার্ভে ও নিবন্ধনের জন্য দালালের কাছে না গিয়ে সরাসরি কার্যালয়ে গিয়ে আবেদন করেন, সেসব নৌযানও তিনি নিজে পরিদর্শন করেন না। বিশ্বস্ত পিয়ন মামুনুর রহমান ওইসব নৌযান মাপ-জোক করে ছবি তুলে আনেন, মালিকের কাছ থেকে অঘোষিত নিয়মমাফিক নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকাও নেন মামুন। এরপর সার্ভেয়ার নিজ দপ্তরে বসে সার্ভে-নিবন্ধন সনদ দিয়ে দেন।
শাহরিয়ার হোসেনও প্রতি নৌযান সার্ভে বাবদ ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা এবং রেজিস্ট্রেশনের জন্য ১-৩ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন।
দুদকে দায়ের করা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সার্ভেয়ার মাহবুবুর রশীদ মুন্না দৈনিক গড়ে ২০টি নৌযান সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন করছেন; যদিও নিয়ম অনুযায়ী একজন সার্ভেয়ার দিনে সর্বোচ্চ ১০টি সার্ভে করতে পারেন। নৌযানের আয়তন ও শ্রেণিভেদে প্রতি নৌযান রেজিস্ট্রেশন বাবদ ১-৩ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন তিনি। আর সার্ভে বাবদ নেন প্রতি নৌযানে ৩০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত।
এছাড়া মুন্না রাজধানীর বনশ্রীর আফতাব নগরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দালাল-মারফত কাগজে-কলমে সার্ভে-রেজিস্ট্রেশনের কারবার চালাচ্ছেন। /