দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক:
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন ,১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে রক্ষা করতে না পারা এবং তাকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে রাজপথে নামতে না পারার লজ্জা আমাদের চিরদিন বহন করতে হবে। তিনি বলেন, এটা কেউ স্বীকার করুক বা না করুক। কিন্তু এটাই বাস্তব সত্য কথা।
শনিবার (১৫ আগস্ট) গেসুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫ তম শাহাদত বার্ষিকী ও জাতীয় শোকদিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় দুদক চেয়ারম্যান এই কথা বলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে নিহত সকল শহিদের বিদহেী আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, জাতির পিতার খুনিরা ১৫ আগস্ট জাতির ললাটে কলঙ্কের তিলক এঁকে দিয়েছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এ কলঙ্কের তিলক বয়ে বেড়াতে হবে। এই জঘন্য হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করে আমি বা আমরা রাজপথে নেমে আসি নাই- এটাই আমাদের লজ্জা। খুনিদের বিচার করে লজ্জার আংশিক মোচন হতে পারে, কিন্তু পরিপূর্ণ মোচন কখনই হতে পারে না।
তিনি তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতি মন্থন করে বলেন, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ২য় বর্ষের ছাত্র। ১৪ আগস্ট আরামবাগের এক আত্মীয়র বাসায় ছিলাম। পরদিন নতুন জামা পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব-শতাব্দীর মহানায়ক জাতির পিতাকে ২য় বারের মতো দেখতে । হৃদয়ের গভীর ছিল এক চরম উত্তেজনা । কিন্ত ঘাতকদের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড জাতির পিতাকে দ্বিতীয়বার দেখার সৌভাগ্য আর আমার জীবনে ঘটেনি।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ১৯৯৪ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এক প্রশিক্ষণে জাপান যাই। সেই প্রশিক্ষণের প্রথম দিনেই বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে জাপনি এক নারী কর্মকর্তা সবার সামনে আমাকে প্রশ্ন করেন – আপনারা কীভাবে আপনাদের জাতির পিতাকে হত্যা করলেন ? এ প্রশ্নের উত্তর আমি সেদিন দিতে পারি নাই। আজও এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। ১৭টি দেশের প্রতিনিধিদের সামনে সেদিন লজ্জিত হয়েছিলাম। সে লজ্জা আজও মোচন হয়নি ।
তিনি বলেন, আমি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলাম। যখনই আইন বা বিধি-বিধান নিয়ে আলোচনা হতো তখন দেখতাম সব আইন ও বিধি-বিধানের উৎস ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত-জাতির পিতার শাসনামলে প্রণয়ন করা। আজ যে আইনের ভিত্তিতে সমুদ্র বিজয় হয়েছে এই আইনও জাতির পিতার শাসনামলে করা। আমাদের অনুধাবন করতে হবে, কতটা দূরদর্শী নেতৃত্ব থাকলে জাতিসংঘ উপস্থাপন করা যায়-এমন একটি আইন তখনই প্রণয়ন করা হয়েছিল। বিস্ময়করভাবে আমরা দেখি আমাদের দেশের সকল কর্মপ্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি জাজ্জ্বল্যমান । সংবিধান থেকে শুরু করে অধিকাংশ মৌলিক আইন ও বিধি-বিধান জাতির পিতার শাসনামলেই প্রণয়ন করা।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জাতির পিতা দেশের উন্নয়নের ভিত্তি রচনা করে গেছেন। দেশকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সকলের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের যে ষড়যন্ত্রকারীরা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেছিল- সেসব ষড়যন্ত্রকারী ও তাদের দোসররা হয়তো আজও সক্রিয়। রক্ত পিপাসু ষড়যন্ত্রকারীদের কাজই দেশের অগ্রগতিকে বাধা দেওয়া।
তিনি বলেন, জাতীয় শোক দিবস বার বার আসবে । আমাদের স্মৃতির মানসপটে বার বার ভেসে উঠবেন দীর্ঘদেহী মহীরুহ মহান দেশপ্রেমিক বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবের প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিচ্ছবিকে সামনে নিয়ে শোকে মুহ্যমান না থেকে- শক্তিতে পরিণত হতে হবে । দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বৈষম্যহীন সোনার বাংলা পরিণত করতে হবে। প্রতিটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, জাতির পিতা বার বার দুর্নীতির বিরুদ্ধে দীপ্ত উচ্চারণ করেছেন। তাঁর বক্তৃতায় বার বার উঠে এসেছে ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে দীপ্ত শপথ। তাই আসুন , আমরা দৃঢ়ভাবে শপথ নিই, আমরা নিজেরা দুর্নীতিমুক্ত থেকে দুর্নীতি দমনে আমাদের আইনি দায়িত্ব নির্মোহভাবে পালন করি। তাহলেই জাতির পিতার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে।
তিনি আরও বলেন, অনেকে আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা প্রথম থেকেই সমালোচনাকে সাধুবাদ জানাই। আমরা সমালোচনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আত্মসমালোচনা করে আত্মশুদ্ধির পথে এগোতে চাই। তবে বস্তুÍনিষ্ঠ সমালোচনা হলে আত্মশুদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়।
দুদক কমিশনার ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খান জাতির পিতার জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, জাতির পিতার ৫৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে কখনও মুজিব ভাই, কখনও বঙ্গবন্ধু , জুলিও কুড়ি কখনও জাতির পিতা সবই হয়েছেন। জীবনের সিংহভাগ কারাগারে কাটিয়েছেন। কারাগারকে তিনি লাইব্রেরি মনে করতেন। রাজনীতির এই মহান কবি জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে কাজে লাগিয়েছেন।
আমি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ শুনে ভেবেছিলাম, এই খবরটি যেন মিথ্যা হয়; তিনি বেঁচে আছেন। কিন্তু খবরটি সত্য হয়েছে। তবে “রাত পোহাতে যদি শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই” – এই গানটির মধ্যে আমি আমার সেদিনের ভাবনাকে খুঁজে পাই।
তিনি আরো বলেন, জাতির জীবনে চরম দুর্ভাগ্য যে জাতির পিতার সাথে তাঁর পরিবারের শিশু ও নারী সদস্যদেরও হত্যা করা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই নারী ও শিশুদের যুদ্ধের বাইরে রাখা হতো। খুনিরা কত নিষ্ঠুর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শেখ কামাল ও শেখ জামালের স্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর শিশু পুত্র শেখ রাসেলকেও সেদিন হত্যা করেছে।
তিনি বলেন, বিশ^াসঘাতকরা কখনই পরিত্রাণ পাবে না। নৃশংস এই হত্যার সাথে যারা জড়িত তাদের কারো কারো বিচার হয়েছে। কারো কারো স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসে তারা বিশ্বাঘতক হিসেবে চিহ্নিত। তারা মীরজাফর , ঘসেটি বেগম বা ক্লাইভদের উত্তরসূরী।
দুদক কমিশনার এ এফ এম আমিনুল ইসলাম মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার প্রতিটি আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা উপস্থাপন করেন। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ঐতিহাসিক ছয়দফা,ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানসহ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
তিনি বলেন , যে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি জাতির পিতাকে ফাঁসি দেওয়ার সাহস পায়নি। সেই জাতির পিতাকে এদেশেরই বিপদগামী কতিপয় কুলাঙ্গারের হাতে জীবন দিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সরকারি কর্মকর্তাদেরকে জনগণের খাদেম বা সেবক হতে বলতেন। এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বা¯Íবায়নে কঠোর হাতে দুর্নীতি বন্ধ করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।
আলোচনা সভায় দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখ্ত বলেন, জাতির পিতা বিশ^ দরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাংলাদেশকে নেতৃত্বহীন করার উদ্দেশ্যেই প্রতিক্রিয়াশীল চক্র জাতির পিতাকে ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। আজ তারই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা তাঁর জীবদ্দশায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার কোন বিকল্প নেই। বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে এ দায়িত্ব পালন করছে। দুদকের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সকলকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
দুদকের প্রশাসন অনুবিভাগের মহাপিরচালক মোঃ জহির রায়হানের সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দুদকের মহাপিরচালক আবদুন নূর মুহম্মদ আল ফিরোজ, মোঃ রেজানুর রহমান, পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন প্রমুখ।
১৫ আগস্ট শহিদদের উদ্দেশ্যে বিশেষ মোনাজাত পরচিালনা করেন দুদক মহাপিরচালক(লিগ্যাল) মোঃ মফিজুর রহমান ভুঞা। । আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মহাপিরচালক সাঈদ মাহবুব খান, একেএম সোহেল, মোঃ জাকির হোসেনসহ পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকতাগণ। # কাশেম