দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক:
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতার পেছনে খাল-নালা-জলাশয় ও নিম্নভূমি দখল এবং ভরাট, অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভাব ও সমন্বয়হীনতা, ভবন ও স্থাপনা নির্মানের পর পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিকল্পিত উপায়ে যথাযথ জলধারণ এলাকা বা জলাশয় নির্মাণ না করা সহ বহুবিধ কারণ রয়েছে।
একইসাথে জলাশয় ও নদীর যথাযথ প্রবাহ ও নাব্যতা নিশ্চিত করা, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, ড্রেনেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ এর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি করা সহ প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রকৌশলগত সমাধানের সাথে পরিকল্পনাগত বিশ্লেষণের যথাযথ সংশ্লেষের করার মাধ্যমে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা দূর করা সম্ভব।
গত বৃহস্পতিবার ১৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) আয়োজিত “চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি কবে?” শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা উপরোক্ত মত প্রদান করেন।
বি.আই.পি.-র প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ এর সভাপতিত্বে এবং সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌ. আহমেদ মাইনুদ্দীন এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রকৌ. রফিকুল ইসলাম মানিক।
এছাড়াও সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান ড. মোঃ রিয়াজ আকতার মল্লিক, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম এর চিফ রিপোর্টার জনাব ভূঁইয়া নজরুল, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি’ চট্টগ্রাম এর উপ-উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) পরিকল্পনাবিদ মোঃ আলী আশরাফ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স’ চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সহ-সভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোঃ শাহীনুল ইসলাম খান, অধ্যাপক এ কে এম আবুল কালাম এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এর সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রকৌ. রফিকুল ইসলাম মানিক, অবৈধ বাসিন্দাদের খালগুলোকে ময়লা আবর্জনা ফেলার জায়গা হিসেবে বিবেচনা করা কে জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে তুলে ধরেন। এছাড়াও খালের পানির শেষ গন্তব্যের ধারণক্ষমতা যদি কম থাকে তাহলেও জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসন সম্ভব না বলে মন্তব্যকরেন এবং একই সাথে কর্নফুলী নদীর ড্রেজিং এর গুরুত্বের কথাও বলেন তিনি। প্রকল্প হস্তান্তরের পর তার রক্ষণাবেক্ষণ দায়িত্ব একটা নির্দিষ্ট সংস্থাকে দেয়ার ব্যাপারে মত দেন তিনি।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌ. আহমেদ মাইনুদ্দীন চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প অনুমোদন এবং বাস্তবায়নের সার্বিক দিক আলোকপাত করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নে খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের অসুবিধা কথা তুলে ধরেন তিনি।
একইসাথে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেই চট্টগ্রামবাসী এর সুফল ভোগ করতে পারবে বলে দাবি করার পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তাবায়নে সমন্বয়হীনতার কোন সমস্যা নেই বলেও জানান। তিনি আরও বলেন খালগুলোকে রক্ষার জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, তাছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সুফলন পাওয়া সম্ভব নয় ।
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে কিনা তার সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ল্যাফটেন্যান্ট কর্নেল মো শাহ আলী জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে অবৈধ দখলের ফলে বিদ্যমান ৩৬ টা খালের মধ্যে সংযোগহীনতা, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেন এর অভাব, খালের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সার্ভিস লাইন সরবরাহ কে দায়ী করেন।
তিনি জোয়ার ভাটা ও বৃষ্টির পানির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত পদক্ষেপ এবং বাস্তবায়নের চিত্র তুলে ধরেন। এছাড়াও সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এমন ২২ টি চিহ্নিত এলাকার কথা উল্লেখ করে ৫২.৮৮ কি.মি. ড্রেন সম্প্রসারণের মাধ্যমে সেকেন্ডারি ড্রেন থেকে খালে সংযোগ বৃদ্ধি করা এবং যেসব এলাকায় ড্রেন ছিলো না সেখানে ১০.৭৭কি.মি. নতুন ড্রেন নির্মাণের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।
দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম এর চিফ রিপোর্টার জনাব ভূঁইয়া নজরুল চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার গত ২৫বছরের সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন ৯০ দশকের শেষের দিকে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে।
জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানের জন্য একটি মেগা প্রকল্প অনুমোদন করা হয় কিন্তু মহা পরিকল্পনায় যে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান ছিলো সেটা বাস্তবায়ন না হওয়ায় জলাবদ্ধতার সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন গত ২৫ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন কোন খাল খনন করা হয়নি। এছাড়াও তিনি জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসনে সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনার অভাবকেও দায়ী করেন। জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রচুর প্রকল্প থাকা সত্ত্বে সমন্বয়হীনতার অভাবে সমস্যার সমাধান না হওয়াকেও দায়ী করেন তিনি।
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম এর উপ-উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) পরিকল্পনাবিদ মোঃ আলী আশরাফ চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতাকে বিষফোঁড়া বলে অভিহিত করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন মহা পরিকল্পনা এবং সেগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার পিছনে মহা পরিকল্পনার বিভিন্ন ধাপ গুলো অনুসরণ না করাকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন আমাদের অনেক প্রকল্প পরিকল্পনা রয়েছে কিন্তু পরিকল্পনা গুলোর বাস্তবায়ন নেই। এছাড়াও তিনি চলমান তিনটি মেগা প্রকল্পের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে ‘ইনফরমেশন ব্ল্যাক আউট’ বলে উল্লেখ করেন। ১৯৯৫ এর মহা পরিকল্পনার সাথে বর্তমানের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের তুলনা করতে গিয়ে ১৯৯৫ মহাপরিকল্পনার “ফ্ল্যাড রিটেনশন পন্ড” এবং “ফ্ল্যাড রিটার্ন পিরিয়ড” এর প্রস্তাবনাসমূহের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান ড. মোঃ রিয়াজ আকতার মল্লিক চট্টগ্রাম জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের টেকসই ও স্থায়িত্বশীলতা নিয়ে বলতে গিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তনকে প্রধান কারণ হিসেবে অভিহিত করে ফ্ল্যাড রিটেনশন। রিটার্ন পিরিয়ডের প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণের উপর গুরুত্ব আলোকপাত করে প্রকল্পে প্যারামিটার গুলো সংযোজন করার কথা বলেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনগনের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক পরিকল্পনার কথাও বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সহ-সভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোঃ শাহীনুল ইসলাম খান বলেন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প যদি সঠিক ডিজাইন এবং পরিকল্পিত হয় তাহলে এর সুফল অবশ্যই সম্ভব। তিনি ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানের সাথে ওয়াসার কাজের ধারাবাহিকতার উপর গুরুত্বারোপ করেন এবং প্রকল্প প্রণয়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার আহবান জানান।
বি.আই.পি.-র প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের জলাবদ্ধতার সাথে তুলনা করে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার চরিত্রের ভিন্নতার কথা বলেন। তিনি আরও বলেন ৯৫ এর মাস্টার প্ল্যান যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলে এই জলাবদ্ধতা সমস্যা এতোটা ভয়াবহ হতো না। এছাড়া তিনি জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে পরিকল্পনাবিদদের সংশ্লিষ্টতা থাকার প্রয়োজনীয়তার উপর ও গুরুত্বারোপ করেন।
বি.আই.পি-র মাধ্যমে চট্টগ্রামের মতো দেশের অন্যান্য শহরের সমস্যা গুলোও জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরার আশা ব্যক্ত করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এর সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান; একইসাথে দেশের উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে বিভাগীয় ও আঞ্চলিক শহরগুলোকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহবান জানান। # প্রেস বিজ্ঞপ্তি ।