আবুল কাশেম, দূরবীণ নিউজ :
কোটিপতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ড্রেন ক্লিনার দাদন ওরফে দাদন হাজী । বিনা ডিউটিতে নিয়মিত মাসিক বেতন নিচ্ছেন মাস্টার রোলের কর্মচারী ড্রেন ক্লিনার দাদন। তবে তার পরিবর্তে অন্য একজনকে তার পক্ষে মাঝে মধ্যে ডিউটি করান বলে জানা যায়। দাদন হাজী সুযোগ মতো এসে হাজিরা খাতায় সই -স্বাক্ষর করেন। এই সিস্টেমেই চলছে মাসের পর মাস। এসব দেখার এবং বলার যেন কেউ নেই।
সরেজমিনে অনুসন্ধান ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘ রাকিব এন্টারপ্রাইজের’ মালিক ক্লিনার দাদন হাজী। ড্রেন ক্লিনার হলেও দাদন চলেন জমিদারী স্টাইলে, ব্যবহার করেন প্রায় ৫০/৬০ লাখ টাকা মূল্যের বিলাশবহুল গাড়ি (গাড়ি নম্বর-ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৬৫০৫)। রেখেছেন ড্রাইভার এবং ব্যক্তিগত সহকারি। ডিএনসিসির অনেক কর্মকর্তাও তার মতো এতো দামী গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন না। তার গাড়িতে ডিএনসিসির মনোগ্রামযুক্ত স্টিকারও লাগানো হয়েছে। প্রতিবছর হজ্জ্বে করতে চলে যায় মক্কা ও মদিনায়। ড্রেন ক্লিনার দাদন এবারও করোনার ভয়াবহতা শুরুর পূর্র মূহুর্তে মক্কা- মদিনা ঘুরে এসেছেন ওমরাহ করতে গিয়ে।
ক্লিনার দাদন ডিএনসিসির বার্ড্ডায় ২১ নম্বর ওয়ার্ডে কর্মরত একজন পরিচ্ছন্ন পরিদর্শককে একটি মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন। যার নম্বর- ঢাকা মেট্রো-ল- ২৩-৬২২০। ওই ওয়ার্ডের বেসরকারি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজের ঠিকাদার ‘রাকিব এন্টারপ্রাইজের’ মালিক ক্লিনার দাদনও তার সহযোগিরা। তার প্রতিষ্ঠানকে নানা কৌশলে সহায়তার জন্যই তিনি ওই পরিচ্ছন্ন পরিদর্শককে মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন। আরো একাধিক নামী গাড়ি রয়েছে তার।
ছবির – এই মোটরসাইকেলটি চালান ডিএনসিসির একজন পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক
সিটি করপোরেশনের আইনের পরিস্কার বলা আছে, কোনো সরকারি/ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা- কর্মচারী কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবেন না। এরপরও তারা কিভাবে ডিএনসিসিতে চাকরিরত অবস্থায় এই সংস্থায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে কোটি কোটি টাকার ব্যবসার নামে নানা কৌশলে লুটপাট করে যাচ্ছেন।
ক্লিনার দাদন আরো ২/৩ জনকে সাথে নিয়ে ‘রাকিব এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তার এই প্রতিষ্ঠানটি ডিএনসিসি থেকে প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ডিএনসিসির নাখালপাড়া এলাকায় ২৫ নম্বর ওয়ার্ড ও বার্ড্ডায় ২১ নম্বর ওয়ার্ডসহ আরো নতুন কয়টি ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্ন কাজের ঠিকাদার তার প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও ডিএনসিসিতে অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ ড্রেন পরিস্কাররে কাজের ঠিকাদারও ড্রেন ক্লিনার দাদন। মিরপুরের অঞ্চল-২, মিপুর অঞ্চল-৪ সহ আরো বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্বে রয়েছে ক্লিনার দাদন।
জানা যায়, রেকর্ডপত্রে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজে নিয়মিত এবং অনিয়মিত সবমিলে প্রায় ৪ শতাধিক ক্লিনারের (নিয়োগ) নামে প্রতিমাসে জনপ্রতি গড়ে প্রায় ১৪ হাজার টাকা হিসেবে মোটা অংকের বিল নিচ্ছেন ক্লিনা দাদনের প্রতিষ্ঠান। তবে ওই ক্লিনার বা শ্রমিকদেরকে জনপ্রতি গড়ে দিচ্ছেন মাত্র ৭/৮ হাজার টাকা করে। বাকি টাকা ডিএনসিসির বেতনভুক্ত কর্মচারী ড্রেন ক্লিনার দাদন, তার ব্যবসায়িক পার্টনার এবং ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যান্ত্রিক শাখার একাধিক কর্মকর্তার মধ্যে ভাগা ভাগি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাস্তবে মাঠে ময়দানে কত জন ক্লিনার কিংবা শ্রমিক কাজ করেন, খতিয়ে দেখা দরকার। দ্রুত সরেজমিন তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে অনেক অজানা তথ্য। ডিএনসিসিও আর্থিকভাবে লাভবান হবে বলে অভিমত রয়েছে অনেকের।
ছবিতে – পাঞ্জাবী ও মাস্ক পরিহিত, বাম হাতে মানি ব্যাগ বহনকারী গাড়িটির সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিই ডিএনসিসির ড্রেন ক্লিনার দাদন। তিনি’ রাকিব এন্টারপ্রাইজের’ মালিক হিসেবে এই গাড়িটি ব্যবহার করেন। গত ১১ জুন, ২০২০ ইং দুপুরে কাওরানবাজার ডিএনসিসির আঞ্চলিক অফিসের সামন থেকে ছবিটি তোলা হয়।
এখানেই শেষ নয় , দাদনের রাকিব এন্টারপ্রাইজে ডিএনসিসির ২৫ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে এসটিএস-এ ‘ভ্যান সার্ভিসের লোকজনের জমানো ময়লা আর্জনা ট্রাকের মাধ্যমে আমিনবাজারে ল্যান্ডফিল্ডে ফেলার ঠিকাদারও বটে। আর এই প্রতিষ্ঠানটি ময়লা আর্বজনা টানার বিনিময়ে ওজন হিসেবে ডিএনসিসি থেকে বিল নেয়। এই সুবাধে তারা ময়লা আবর্জনার সাথে কৌশলে মাটি. কাঁদা এবং নির্মাণাধীন বিভিন্ন ভবন- স্থাপনা, রাস্তা, গলিপথ মেরামতের পর ফেলে রাখা রাবিশ এবং ভারী আর্বজনা বেশি নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর, অথচ তাদের কোনো জবাব দিহিতা নেই। এমনকি নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরদেরকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে মাসে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজে প্রতিমাসে কত টাকার বিল করা হয়, তা জানতে দেওয়া হয় না।
আরো জানা যায়, আঞ্চলিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রকৌশলীদের সহযোগতায় বিল অনুমোদন ও বিল প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। রাকিব এন্টারপ্রাইজের মালিকদের একজন ড্রেন ক্লিনার দাদন । এই বিষয়টি ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রকৌশলী, কর্মকর্তাদের অনেকেই জানেন। জরুরি ভিত্তিতে কমিটির মাধ্যমে তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে প্রতিমাসে কোটি টাকা লুটপাটের অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ক্লিনার দাদন এতই প্রভাবশালী যে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তিনি । কারণ তার রয়েছে বিশেষ সিন্ডিকেট। অঞ্চল -৩ এর সাবেক (সাময়িক বরখাস্ত) সহকারী বর্জ্য ব্যবস্থপনা কর্মকর্তা মো. আনিচুল হকের সহযোগি হিসেবে মেয়রের দপ্তরে ড্রেন ক্লিনার দাদনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। ডিএনিসিসির পক্ষ থেকে শুধুমাত্র অঞ্চল -৩ এর সাবেক সহকারী প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থপনা কর্মকর্তা মো. আনিচুল হকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু ড্রেন ক্লিনার দাদনের বিষয়টি চাপা পড়ে রয়েছে। ফলে দাদন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
জানা যায়, দাদন রাজধানীর বাড্ডায় স্বাধীনতা স্মরনীতে একটি বিলাশবহুল ফ্ল্যাট ক্রয় করে সপরিবারে বসবাস করেন। রাজধানীর উপকণ্ঠে কেরানীগঞ্জ উপজেলার শাখতা ইউনিয়নে জমি ক্রয় করে বিশাল বাড়ি বানিয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে রয়েছে অনেক সম্পদ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তার এবং পরিবারের সদস্যদের নামে- বেনামে দোকান, প্লট থাকতে পারে বলে জানান ডিএনসিসির সাধারণ কর্মচারীরা।
এদিকে এসব বিষয়ে ড্রেন ক্লিনার দাদন বলেন, হজ্জ্বে যাওয়াটা তার একটা নেশায় পরিনত হয়েছে। টাকা হাতে আসলেই তিনি ওমরা করতে চলে যান মক্কা আর মদিনায়।
তিনি ডিএনসিসিতে ব্যবসা করার বিষয়টি স্বীকার করেন। বাড্ডায় ফ্ল্যাট এবং কেরানীগঞ্জে জমি কিনে বাড়ি করার বিষয়টিও স্বীকার করেছেন এবং তারা বাড়ি কেরানীগঞ্জে বলে পরিচয় দেন। তার ময়লা টানার একাধিক ভ্যান গাড়ি আছে বলে জানান। কিন্তু তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে এটা এড়িয়ে যান। তিনি বিনা কাজে বেতন নিচ্ছেন এবং ব্যবসা করার অভিযোগ সম্পর্কে কোনো জবাব দেননি।
ডিএনসিসির অঞ্চল-২ এর সহকারী প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. মহসিনের কাছে ড্রেন ক্লিনার দাদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে উত্তরা থেকে মিরপুরে নতুন দায়িত্বে এসেছেন। যারফলে দাদন সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তবে ১০০ ভাগ হাজিরা এবং নিয়মিত কাজ করার জন্য সব ক্লিনারকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। দাদনের আপন বোন এই অঞ্চলে ক্লিনারের চাকরি করেন বলে জানতে পেরেছেন। তিনি ড্রেন ক্লিনার দাদনের বিয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন বলে জানান। # কাশেম