দূরবীণ নিউজ প্রতিনিধি:
হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান, ই-অরেঞ্জের মালিকরা অবৈধভাবে অরেঞ্জের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের’ মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ই-অরেঞ্জের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে’ অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেনের চাঞ্চ ল্যকর তথ্য রয়েছে।
প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসছে ‘ই-অরেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া মেহজাবীন, তার ভাই পুলিশ পরিদর্শক (বরখাস্ত) শেখ সোহেল রানা ও চাচা মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ নানা কৌশলে ও প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের ১৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা সরিয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ অল্প সময়ের মধ্যে তাদের সুবিধামতো সংশ্লিষ্ট হিসাব থেকে এসব টাকা পাচার (সরানো) করেছেন।
বুধবার (২ অক্টোবর) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেে বিএফআইইউ’র পক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এর আগে হাইকোর্ট ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের কাছে আটকে থাকা গ্রাহকের টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে কি না, সেটি খুঁজে দেখতে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়ে ছিলেন ।
গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন রিটকারী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. আব্দুল কাইয়ুম লিটন। তিনি আরও জানান,‘ই-অরেঞ্জ থেকে ৭৭ কোটি টাকার পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার ৫৪৭ জন গ্রাহকের পক্ষে মো. আফজাল হোসেন, মো. আরাফাত আলী, মো. তরিকুল আলম, সাকিবুল ইসলাম, রানা খান ও মো. হাবিবুল্লাহ জাহিদসহ ৬জন গ্রাহক ২০২২ সালের মার্চে হাইকোর্টে রিট করেন। গত ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২২ সালের সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুল জারি করেছেন। উচ্চ আদালত একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে প্রতিবেদন চেয়েছেন।
রুলে গ্রাহকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় ই-অরেঞ্জের সঙ্গে সম্পৃক্ত বনানী থানার সাময়িক বরখাস্ত পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানা, স্বত্বাধিকারী সোনিয়া মেহজাবিন ও বিথি আক্তারসহ অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রাহক ঠকানো ও অর্থপাচারের অভিযোগে আইনি ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তার জবাব চেয়েছেন।
আদালত আদেশে আরও জানতে চাওয়া হয়েছিল,বিবাদী সোহেল রানা, স্বত্বাধিকারী সোনিয়া মেহজাবিন ও বিথি আক্তারসহ অন্যদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করে ক্ষতি অনুপাতে আবেদনকারীসহ অন্যান্য প্রতারিত গ্রাহকদের মাঝে সে টাকা বণ্টন বা বিতরণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে। ওই আদেশ অনুসারে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
আদালতে ওইদিন আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আহসানুল করিম ও আব্দুল কাইয়ুম লিটন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার শামীম খালেদ।
গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় অভিযুক্ত ই–অরেঞ্জের সঙ্গে সম্পৃক্ত সোহেল রানাকে ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সীমান্ত এলাকা থেকে আটক করা হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা অনুপ্রবেশের অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত থেকে তাকে আটক করে। পরে ৫ সেপ্টেম্বর তাকে সাময়িক বরখাস্তের কথা জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশ।
বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনে বলা হয়, ই-অরেঞ্জ, অরেঞ্জ বাংলাদেশ ও রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনালের নামে ১৩টি হিসাব খুলে লেনদেন করেন। এ ১৩ হিসাবে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লেনদেন করেছেন। এই সময়ে ১,১১১ দশমিক ৪৫ কোটি টাকা জমা ও ১,১০৯ দশমিক ৯৭ কোটি টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মোট ২,২২১ দশমিক ৪২ কোটি টাকার লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে। আর সোনিয়া ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানের নামে ২৪টি হিসাবে লেনদেন করা হয়। ওই ২৪টি হিসাবের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে সন্দেহভাজন দুই ব্যক্তি প্রায় ১২০ কোটি টাকার লেনদেন করেন। এসব হিসাব স্থগিতের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সিআইডির অনুরোধের প্রেক্ষিতে তাদের পরিচালিত সব হিসাব লেনদেন ২০২১ সালের ২৫ জুলাই স্থগিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রাথমিক পর্যায়ে এটির মালিকনায় সোনিয়া মেহজাবিন থাকলেও পরবর্তীতে তা পরিবর্তন করে তার ভাই পুলিশ কর্মকর্তা (বরখাস্ত) শেখ সোহেল রানার স্ত্রী নাজনীন নাহারা বিথির নামে হস্তান্তর করা হয়।
অর্থ স্থানান্তরের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সোনিয়া মেহজাবিন, স্বামী মাসুকুর রহমান, ভাই শেখ সোহেল রানা ও চাচা মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ নগদে টাকা উত্তোলন ও ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর এবং নিজ নামে ক্রয় করার জন্য মোট ১৮ দশমিক ৫৬ কোটি টাকা ই-অরেঞ্জের হিসাব হতে স্থানান্তর/উত্তোলন করেন। গ্রাহকদের অগ্রিম মূল্য পরিশোধিত অর্ডারের কাঙ্ক্ষিত পণ্য সরবরাহ না করে সন্দেহভাজন উল্লিখিত অর্থ তাদের ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর নগদে উত্তোলন ও ব্যক্তিগত স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করেছেন মর্মে পরিলক্ষিত হয়েছে, যা প্রতারণার শামিল।
উল্লেখ্য, এসএসএল কমার্স কর্তৃক ৩ লাখ ৪ হাজার ৫২৫টি অর্ডারের বিপরীতে ৯০০ কোটি টাকা ই-অরেঞ্জ শপকে পরিশোধ করা হলেও উক্ত অর্ডারের পণ্য গ্রাহক বা ভোক্তাদেরকে প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহ করেছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বর্তমানে ই-অরেঞ্জ.শপ এর গ্রাহক কর্তৃক পরিশোধিত মোট ১০ হাজার ১৮৭টি অর্ডার আইডির বিপরীতে প্রায় ৩৪.৬২ কোটি টাকা অনিষ্পন্ন/অপরিশোধিত অবস্থায় হিসাবে জমা আছে। পেমেন্ট গেটওয়ে ছাড়াও গ্রাহকরা সরাসরি ই-অরেঞ্জ.শপ, অরেঞ্জ বাংলাদেশ ও রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল এর ব্যাংক হিসাবে ছোট ছোট অংকে নগদ জমা ও অনলাইন ট্রান্সফারের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়ের অর্থ জমা করেছেন মর্মে পরিলক্ষিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত অর্থ থেকে বিভিন্ন মার্চেন্টকে সময়ে সময়ে মোট ৪৯৭.৭৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব মার্চেন্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে অল জোন কে ১৮৮.৬৪ কোটি টাকা, বাজাজ কালেকশনকে ১২৬.৩৭ কোটি টাকা, বাবু টেলিকমকে ৮.৭৩ কোটি টাকা, টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেডকে ৯.৫৩ কোটি টাকা, এনবিএস ডিস্ট্রিবিউশন- কে ১৮.১৭ কোটি টাকা, বাইক ভ্যালি ঢাকা- কে ২.৩৪ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডকে ১৮.৯ কোটি টাকা, এসিআই লজিস্টিকস সার্ভিসেস লি. কে ৩০.৪১ কোটি টাকা, বাটারফ্লাই মার্কেটিং লিমিটেডকে ৫.৩৩ কোটি টাকা, গিয়ার এক্স বাংলাদেশ লি. কে ১.৮৩ কোটি টাকা, নিলয় মটরস লি. কে ১.৬৯ কোটি টাকা, আজিয়াটা ডিজিটাল সলিউশনস লি.-কে ০.৭২ কোটি টাকা, একেএস গেøাবাল ট্রেডিং লি.-কে ১.৫৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনের সার্বিক পর্যালোচনা অংশে বলা হয়েছে, ই-অরেঞ্জ.শপ, অরেঞ্জ বাংলাদেশ ও রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক কমমূল্যে গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন লোভনীয় অফারে প্রলুব্ধ করে বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের কাছ থেকে অর্ডারের মূল্য বাবদ প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। পরে জমা করা অর্থ থেকে বিভিন্ন মার্চেন্টকে পরিশোধ করার পাশাপাশি সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, ভাই শেখ সোহেল রানা ও চাচা মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ কর্তৃক নগদে উত্তোলন ও ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর এবং নিজ নামে স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করার জন্য মোট ১৮.৫৬ কোটি টাকা ই-অরেঞ্জ এর হিসাব থেকে স্থানান্তর/উত্তোলন করেন। যা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২(শ)(৫) ধারা অনুসারে প্রতারণা সম্পৃক্ত অপরাধ। #