দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক :
মহান স্বাধীনতার গত ৫০ বছরে ঢাকা শহর কোনো অভিভাবকত্ব পায়নি বলেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বলেছেন, শুধুমাত্র দৈনন্দিন পরিসেবার কাজগুলো ছাড়া দীর্ঘ এ ৫০ বছরে কোনো নগর পরিকল্পনা হয়নি। তেমন কোনো উন্নয়নমুখী কাজও শহরে করা হয়নি। যারফলে এখন থেকে ঢাকা শহরে সেবাপ্রদানকারী সংস্থাগুলোকে প্রকল্প প্রণয়নের শুরুতেই সিটি করপোরেশনের সাথে সমন্বয় করতে হবে।
বুধবার (২০ জুলাই) বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম’ আয়োজিত ‘রাজধানীর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক নগর সংলাপে অংশ নিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য ঢাদসিক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস এই মন্তব্য করেন।
সংলাপের প্রধান অতিথির বক্তব্যে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, একটি শহর পরিকল্পনা যেভাবে হওয়া উচিত রাজধানী ঢাকার পরিকল্পনা তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু আমরা দুর্ভাগ্যবশত লক্ষ্য করেছি যে পরিকল্পিত পরিকল্পনা উচিত ছিল তা হয়নি। হয়তোবা কিছু হয়েছে; কিন্তু সে পর্যায়ের হয়নি। পরিকল্পনা পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়ে গেছে, বাস্তবায়ন হয়নি।
তিনি বলেন, পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল। পরিকল্পনা তো আদৌ হয়নি বরং তা দিনে দিনে একটি অপরিকল্পিত নগরী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে। যার কারণে বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা সর্বনিম্ন পর্যায় তৃতীয় স্থানে।
তাপস বলেন, এযাবৎকালে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর্যায় তেমন কিছু নজির বা উদাহরণ আমরা রেখে আসতে পারিনি। এটা আসলে বাস্তব চিত্র। কিন্তু আমরা অবশ্যই সবাই আশা করি, স্বপ্ন দেখি নিজের থেকে উত্তরণের। সে উত্তরণের ইচ্ছা বা আগ্রহ নিয়েই আমি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি।
মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, “বিভিন্ন (সেবা সংস্থার) সমন্বয়হীন কার্যক্রম আমাদের জন্য একেকটা বিষফোঁড়া। আমি আশা করব, এ বিষয়গুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষ আরও সদয় বিবেচনা করবেন। প্রকল্প প্রণয়নের সময় আমাদের সাথে মতবিনিময় করবেন। আমাদের পরিকল্পনার সাথে মেলাবেন।”
সমন্বয়হীনতা প্রসঙ্গে উদাহরণ দিয়ে ঢাদসিক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, “এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আমার পান্থকুঞ্জ পার্ক ১০ বছর ধরে বন্ধ করে রেখেছে। ওদিক থেকে এসে আবার এদিক হয়ে কাঁটাবন দিয়ে বলে যাবে! কেন যাবে? এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তো ঢাকার মধ্যে নামার কথা না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে — ঢাকার এক অদূর প্রান্ত থেকে আরেক অদূর প্রান্তে সরাসরি চলে যাবে। ঢাকার মধ্যে নামার কথা নয়। ঢাকা থেকে যানবাহন উঠলে উঠতে পারবে কিন্তু নামবে না।
আপনি নামাবেন, নামিয়ে আবার এখানে যানজট সৃষ্টি করবেন। এই যানবাহনগুলো কোথায় যাবে? আপনি আমার উদ্যানের উপরে বারোটা কলাম দিয়ে উদ্যান নষ্ট করে চলে যাবেন? তাহলে ঢাকাবাসী কি পাবে? ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কি পাবে? আমি যদি স্বার্থসংশ্লিষ্ট অংশীজন হয়ে থাকি তাহলে এই পরিকল্পনা করার সময় কেন আমাকে জানালেন না? এখন এসে আমাকে বলছেন — আমার জমি দিয়ে দিতে হবে।
আমার রাইট অফ ওয়ে দিয়ে দিতে হবে। ওনাদের মতন ওনারা করবেন। আমরা বসে বসে দেখব — ঢাকার উপরে আগ্রাসন! আর পরে জনগণ যখন গালি দিবে, তখন বলবে নগরপিতা কই? বন্ধ করে দিয়েছি। আল্লাহ জানে কি হবে!”
ঢাকাবাসীর কল্যাণে প্রকল্প প্রণীত হলে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে উল্লেখ করে মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, “যেটা ঢাকাবাসীর জন্য ভালো হবে, যেটা ঢাকাবাসীর উন্নয়নের জন্য হবে, যেটা রাজধানীর উন্নয়ন ও নগরবাসীর পরিষেবা নিশ্চিত হবে — সেজন্য প্রকল্প হলে অবশ্যই সেটা বাস্তবায়নের শুধু সহায়তায় নয় বরং সর্বাগ্রে আমরা সহযোগিতা করব।”
মেয়রকে নগরপিতা বলা হলেও দীর্ঘ ৫০ বছরেও করপোরেশনকে কোনও অভিভাবকত্ব দেওয়া হয়নি বলে আক্ষেপ প্রকাশ করে ঢাদসিক মেয়র বলেন, “শুধু দৈনন্দিন পরিষেবার কাজ ছাড়া সিটি করপোরেশন উন্নয়নমুখী, শহরকেন্দ্রিক এবং একটি উন্নত রাজধানী গড়ার জন্য কোনও উন্নয়ন পরিকল্পনা কোনও সময়ই নেয়নি।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ যে সকল সরকারি সংস্থা পরিষেবা দিয়ে থাকে, তাদের প্রকল্পনির্ভর পরিকল্পনার ওপরে সিটি করপোরেশন চলেছে। ওয়াসা যেহেতু নর্দমাকেন্দ্রিক কাজ করত তারা একটি পরিকল্পনা করেছে। পরিবহন ক্ষেত্রে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অভিবাসন, আগ্রাসন, জনগোষ্ঠী — একটি শহরের সকল কিছুকে বিবেচনা করে সামগ্রিকভাবে কোনও পরিকল্পনা আমরা দেখিনি।
তাই, আমি দায়িত্বভার গ্রহণের পর প্রথমেই যে কাজটি শুরু করার চেষ্টা করেছি সেটি হলো — করপোরেশনের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা। আগামী ৩০ বছর ঢাকাকে আমরা কোন পর্যায়ে নিতে চাই, ঢাকার উন্নয়ন কিভাবে করতে চাই, ঢাকার পরিষেবাগুলো কিভাবে নিশ্চিত করতে চাই এবং তা বাস্তবায়নের পথে কিভাবে যেতে পারি — সামগ্রিকভাবে সেই বিষয়গুলো বিবেচনা করেই আমরা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছি। আমরা এই শহর পরিকল্পনা প্রণয়ন আরম্ভ করেছি। এটি চলমান রয়েছে।”
সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রফেসর ড. আকতার মাহমুদ। ঢাকার জনঘনত্বকে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে ড. আকতার মাহমুদ বলেন, “আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, সেটা হলো জনঘনত্ব। ঢাকা শহরের জনঘনত্ব অত্যন্ত উচ্চ। এখানে গড়ে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৮ হাজার মানুষ বসবাস করে। কোনও কোনও ওয়ার্ডে এর চেয়েও অনেক বেশি মানুষ বসবাস করে।”
সংলাপে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিয়া ও চাইনিজ এন্টারপ্রাইজ এসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশ এর সভাপতি মি. কে চ্যাংলিয়াং বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন।
নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সোহেল মামুনের সঞ্চালনায় ও সংগঠনের সভাপতি অমিতোষ পালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার, ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি ফারহানা শারমিন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন শিপলু, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ফজলে রেজা সুমন, রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম প্রমুখ অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন। #