দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক:
নানা অনিয়ম ও দুর্নীতরি মাধ্যমে রাজশহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) ফ্লাড লাইট প্রকল্পের ৬ কোটি টাকার লুটপাটের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। ‘হ্যারায় ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওই প্রকল্পের অর্থ লুটপাটের অভিযোগ পেয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম মাঠে নেমেছেন।
জানা যায়, দুদকের রাজশাহী বিভাগের সমন্বিত জেলা কার্যালযয়ের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিনের নেতৃত্বে গত ৪ অক্টোবর একটি টিম প্রকল্প এলাকায় অভিযান চালায়।দুদক টিমের সদস্যরা প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট রেকর্ড, রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রেয়াজত হোসেন ও সহকারী প্রকৌশলী এবিএম আসাদুজ্জামান সুইটের বক্তব্য নেয় টিম। এই সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব পায়নি দুদক।
দুদক পরিচালক (জনসংযোগ) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘অভিযানকালে টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হ্যারায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতার সনদ ও ঠিকানার অস্তিত্ব পায়নি দুদক কর্মকর্তারা। ’
তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশ থেকে আনা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের শিপমেন্ট ডকুমেন্ট, এলসি, বিল অব ল্যান্ডিং, শুল্ক, কর ও ভ্যাট পরিশোধ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অভিযানের সময় রাসিকের এই প্রকল্পের কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।’
জানা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে রাজশাহী মহানগরীর ১৬ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আলোকিত করতে ১৬ ফ্লাড লাইট বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য ৯ কোটি ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬০ টাকা বরাদ্দ করে রাসিক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ৯ জুন ই-জিপিতে উন্মুক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হয়। সব প্রক্রিয়া শেষে হ্যারায় ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয় রাসিক।
প্রতিষ্ঠানটির দর ছিল ৯ কোটি ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৭ টাকা। এরপর গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) মো. রেয়াজত হোসেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
দুদক কর্মকর্তারা রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখতে পান, ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিল পরিশোধ করতে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি ৯ কোটি ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৬০ টাকার প্রাক্কলন প্রস্তুত করেন। যদিও ওই প্রাক্কলনে বাজার দর যাচাই সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।
কিভাবে বাজার দর যাচাই করা হয়েছে, এই বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য জবাব পাওয়া যায়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা অভিজ্ঞতার সনদ যথাযথভাবে যাচাই করেনি রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদেশ থেকে আনা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের শিপমেন্ট ডকুমেন্টস, এলসি, বিল অব ল্যাডিং ও শুল্ক পরিশোধ সংক্রান্ত কোনো কাগজ বিলের সঙ্গে দাখিল করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
দুদকের অনুসন্ধানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থান সরেজমিনে খুঁজে পান কর্মকর্তারাফলে দুদকের রাজশাহী অফিস থেকে এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সুপারিশ করা হয়। দুদকের কাছে অভিযোগ রয়েছে, রাসিকের ১৬ ফ্লাড লাইট বসানো ও সহায়ক উপকরণের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সোয়া দুই কোটি টাকা। কিন্তু রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে ৯ কোটি ৭ লাখ ৭৭ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করেছে। অর্থাৎ ঠিকাদারকে বাজারমূল্যের চেয়ে ৬ কোটি ৮৯ লাখ ৮৪ হাজার ৪৩ টাকার বেশি বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
আরো অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা যোগ করে প্রত্যেক ফ্লাড লাইটের খরচ ধরেছে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৭২ হাজার ৫১৫ টাকা। কিন্তু রাসিকের বিদ্যুৎ বিভাগ প্রতিটি খুঁটির জন্য ‘হ্যারো’কে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা হারে দেয়। এর ফলে প্রত্যেক খুঁটিতে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮৫ টাকা অতিরিক্ত বিল দেওয়া হয়েছে। ফ্লাড লাইটে ব্যবহার করা ২০০ ওয়াট ক্ষমতার ৩২০টি এলইডি লাইটের প্রতিটির বাজারমূল্য ১৫ হাজার ৮৭৩ টাকা হলেও টেন্ডারে ৬৫ হাজার ৫০০ টাকা দেখানো হয়েছে। সব মিলিয়ে ২ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।
এভাবে ২০০ ওয়াটের একটি এলইডির দাম ৬৩ হাজার ৮০০ টাকা করে মোট ২ কোটি ৪ লাখ ১৬ হাজার টাকা পরিশোধ করে রাসিক। অথচ বাজারমূল্যে ৩২০টি এলইডির মোট দাম পড়ে ৫০ লাখ ৭৯ হাজার ৩৬০ টাকা। এক্ষেত্রে ঠিকাদারকে অতিরিক্ত ১ কোটি ৫৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬৪০ টাকা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, ফ্লাড লাইটে সংযোজিত ২০০টি ২৫০ ওয়াট ক্ষমতার এলইডি লাইটের প্রতিটির বাজারমূল্য ১৯ হাজার ৩০৯ টাকা হলেও টেন্ডারে ৭৫ হাজার টাকা হিসাবে মোট ব্যয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়। চীনা আরওএইচএস কোম্পানির তৈরি ২০০টি এলইডির মোট বাজারমূল্য ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৮০৪ টাকা হলেও হ্যারোকে অতিরিক্ত ১ কোটি ১১ লাখ ৩৮ হাজার ২০০ টাকা দেওয়া হয়েছে। এই খাতে মোট বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ৪৭ লাখ ২০ হাজার টাকা।
আর ৬৩ এএমপি অটো লজিক কন্ট্রোলারের এক ইউনিটের বাজারমূল্য ৩৬ হাজার টাকা হলেও ঠিকাদারকে ১৬টি এএমপি কন্ট্রোলারের প্রতি এককের মূল্য ৭২ হাজার টাকা হিসাবে মোট ১১ লাখ ৫২ হাজার টাকার বিল দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে হ্যারোকে অতিরিক্ত ৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বেশি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। একইভাবে ১ হাজার ২৪০ মিটার ক্যাবল সরবরাহেও ঠিকাদারকে ৩৭ হাজার ২০০ টাকা বেশি বিল দিয়েছে রাসিক। #