দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক:
ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন মাত্র দুইদিনের বৃষ্টিতে সব তলিয়ে গেল। এতো উন্নয়ন কোথায় গেল, এই প্রশ্ন জনমনে দেখা দিয়েছে। ঢাকা দুই সিটির পরিকল্পনাবিদন প্রকল্প পরিচালক, আঞ্চলিক নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধি এবং নগরীর জলাবদ্ধা নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
এটা সত্য। এই জন্য নগরবাসীর পক্ষ থেকে তাদেরকে অনেক ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কিন্তু বাধা হয়ে দাড়িঁয়েছে বেরশিক বৃষ্টি। তাদের পরিশ্রম এবং সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন এইভাবে বৃষ্টির জলে গলিয়ে যাবে। এটা নিয়ে নগরবাসীর মাঝে নানা ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। কারণ নগরবাসীর দু’ভোগ কমার পরিবর্তে বেড়ই চলছে।
বাস্তবে কি দেখা যাচ্ছে, মাত্র দুই দিনের এই বৃষ্টিতেই রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা রাস্তা, গলিপথ পানির নিচে । জলাবদ্ধতা ঘটনায় নগরীর উন্নয়ন খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়েপড়েছে। গত ১০ বছরে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিয়ে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন আর ঢাকা ওয়াসার মধ্যকার টেলাঠেলি এবং পরস্পর দোষারোপের শেষ নেই। তবে এই দুই সংস্থাই প্রতিবছর জলাবদ্ধতা মোকাবিলায় শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে যাচ্ছে । কিন্তু জলাবদ্ধা কমার পরিবর্তে বেড়েই চলছে।
এনিয়ে বিশেষজ্ঞরা সবসময়ই কমন বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের বক্তব্য হলো নগরীর নালা ভরাট ও খাল দখল হয়েগেছে। প্রতিবছর রাজধানীর খালগুলো দখল করে নিচ্ছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান। এতে পিছিয়ে নেই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিও। খাল ও দখলদারদের চিহ্নিত করা হলেও উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। যার কারণে জলাবদ্ধতা নিরসন করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।এদিকে ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধানে থাকা ২৫টি খালের পানি প্রবাহের খাল দখল করে কেউ তৈরি করেছে সড়ক, কেউবা তৈরি করেছে ব্রিজ, আবার কেউ নিজেদের ইচ্ছামতো বহুতলা ভবনও তৈরি করেছে। সরকারি পানি নিষ্কাশন নালাকে দখলদার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো কার্যক্রম চালাচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তা-ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মৌখিক নানা প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও বাস্তবে রাজধানীর খালগুলোর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ হচ্ছে না। ফলস্বরূপ প্রতি বছর বর্ষার মৌসুমে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়ে শহরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে।
এদিকে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজধানীর খালগুলোর অবৈধ দখল দারিত্ব, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং পুনঃখনন করতে ঢাকা ওয়াসাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে শহরের ড্রেনগুলো পানি নিষ্কাশন সচল রাখতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘খাল ও নদীর মধ্যে পানি নিষ্কাশন চ্যানেল তৈরি করতে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হলে খালের শ্রেণি পরিবর্তন করে যেসব স্থাপনা করা হয়েছে, সেসব অপসারণ করা হবে।’
জলাবদ্ধতা নিয়ে নগর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজধানীর খালগুলোয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলদারিত্ব অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কোনো কোনো সংস্থা খাল ভরাট করে সড়ক, কেউবা ব্রিজ নির্মাণ করেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খাল দখল করলেও নির্বিকার আছে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। এজন্য রাজধানীর এমন করুণদশা। সামান্য বৃষ্টি হলেই শহরের প্রধান সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যায়।’তিনি আরও বলেন, ‘এতদিন পর দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে খালগুলো পুনরুদ্ধারের চিন্তাভাবনা করছে। তবে কারিগরি প্রতিষ্ঠান হিসেবে খাল পুনরুদ্ধার বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দিলে ভালো ফলাফল মিলবে। অন্য কোনো সংস্থার খাল ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতো অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা নেই।’
জানা যায়, মহানগরীর ঢাকা-ডেমরা মহাসড়কের কাজলার পাড় এলাকা থেকে শুরু হয়ে দেবধোলাই খাল মিশেছে মান্ডা খালে। এ খালের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৯-২৫ মিটার। ডিএসসিসির নির্মিত এই সড়কের পাশে বা মাঝখানে দিব্যি রয়েছে খালের সীমানা পিলার। পিচ ঢালাই সড়ক তৈরি করেছে ডিএসসিসি। প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক বেশ কয়েকটি সীমানা পিলার লক্ষ্য করা গেছে।
স্থায়ী বাসিন্দারা গণমাধ্যমকে জানান, ওই খালের পাশের বাসিন্দারা কোনো রকম সড়কের জায়গা না রেখেই বহুতলা ভবন তৈরি করেছে। পরবর্তীতে তারা সবাই মিলে খালের জায়গা ভরাট করে কাঁচা রাস্তা তৈরি করে। পরবর্তীতে ইউনিয়ন পরিষদ ওই সড়ক ইট বিছিয়ে দেয়। এরপর সিটি কর্পোরেশনে আসলে স্থানীয় কাউন্সিলরের অনুরোধে ডিএসসিসি সেটা পাকা করেছে।
জানা যায়, রামপুরা ব্রিজ থেকে মেরাদিয়া বাজারমুখো প্রবাহিত বেগুনবাড়ি খালের বনশ্রী আবাসিক এলাকা সংলগ্ন অংশ বিশেষ দখল করে ফুটপাত এবং আবর্জনার ডাস্টবিন তৈরি করেছে ডিএনসিসি।
রামপুরা ব্রিজ থেকে বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল পর্যন্ত ফুটপাত তৈরি করেছে ডিএনসিসি। অন্যদিকে বনশ্রী ‘বি’ ব্লক সংলগ্ন খালের জায়গা ভরাট করে আবর্জনার কনটেইনার বসিয়েছে ডিএনসিসি। প্রতিদিন সেখানকার তিনটি কনটেইনারের তরল বর্জ্য (লিচেট) ও পলিথিন খালে পড়ছে। এতে একদিকে খালের পানি দূষিত করছে এবং অন্যদিকে খালের পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে।
রামচন্দ্রপুর খালের মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের ১ নম্বর ব্রিজের পশ্চিম পাশে খালের অংশবিশেষ ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করেছে ডিএনসিসি। ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে বাধা দেয়া হলেও সেটা আমলে নেয়নি ডিএনসিসি। মোহাম্মদী হাউজিংয়ের ৫ নম্বর রোড এলাকা থেকে শুরু হয়ে খালটি আদাবর ১৬ নম্বর রোড পার হয়ে কল্যাণপুর প্রধান খালে গিয়ে মিশেছে। এ খালের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ২৬০ কিলোমিটার। আর প্রস্থ ১৫-২০ মিটার।
খালটি আবর্জনায় ভরে রয়েছে। খালটিকে ভালো করে বোঝাই যায় না। ঢাকা ওয়াসা বছরে এক থেকে দুইবার খালটি পরিষ্কার করলেও সেটা পানি নিষ্কাশন সচল রাখতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
কল্যাণপুর প্রধান খালের ভাঙ্গা ব্রিজ এলাকায় খালের অংশবিশেষ ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করেছে ডিএনসিসি। এ কারণে ওই এলাকার পানি নিষ্কাশন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আগারগাঁও ৬০ ফুট রোডের ভাঙ্গা ব্রিজ এলাকা থেকে শুরু হওয়া খালটির দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪৬০ মিটার এবং প্রস্থ ২০-৩০ মিটার। খালটির সীমানা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। ঢাকা ওয়াসা এবং জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে ওই খালের সীমানা নির্ধারণী কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সারা বছরই খালটি আবর্জনায় ভরা থাকে।
মিরপুরের রূপনগর খালের অর্ধেক ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করেছে । রূপনগর আবাসিক এলাকার ৫ নম্বর রোড থেকে শুরু হয়ে খালটি চটবাড়ি সুইচ গেটের কাছে গিয়ে মিশেছে। খালটি অবৈধভাবে ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করায় বর্ষার মৌসুমে ওই এলাকার পানি নিষ্কাশন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর চরম খেসারত দিতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। #