নিজস্ব প্রতিবেদক :
বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রটি টানা ১৭ বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছে। অবশেষে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ৩০ জুলাই থেকে ১০ দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রশ্নফাঁসে জড়িত ৮ চিকিৎসকসহ ১২ জনকে গ্রেফতার করেছেন। গ্রেফতার হওয়া অপরাধীরা পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে স্বীকার কছেন।
গ্রেফতার হওয়া প্রশ্নফাঁস চক্রের ১২ জন হলেন, চিকিৎসক জসীম উদ্দিন ভ‚ইয়া, চিকিৎসক ময়েজ উদ্দিন আহমেদ ও তার স্ত্রী চিকিৎসক সোহেলী জামান, চিকিৎসক মো.আবু রায়হান, চিকিৎসক জেড এম সালেহীন শোভন, চিকিৎসক মো. জোবাইদুর রহমান জনি, চিকিৎসক জিলুর হাসান রনি, চিকিৎসক ইমরুল কায়েস হিমেল, রওশন আলী হিমু ,জহিরুল ইসলাম ভুইয়া মুক্তার, আক্তারুজ্জামান তুষার, আব্দুল কুদ্দুস সরকার।
সিআইডির কর্মকর্তাদের কাছে এ চক্রের সদস্যরা স্বীকার করেছেন, তারা ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের মতো জগন্য অপরাধ করেছে। তারা ১০ বার প্রশ্ন ফাঁস করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল সংখ্যক ব্যাংকের চেক এবং এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। এদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। রোববার (১৩ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া।
তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ৯টি মোবাইল ফোন, ৪টি ল্যাপটপ, নগদ ২ লাখ ১১ হাজার টাকা, ১৫ হাজার একশ বিদেশি মুদ্রা থাই বাথ, বিভিন্ন ব্যাংকের ১৫টি চেক বই, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ভর্তির এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।
সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া সাংবাদিকেদের বলেন, পাবলিক পরীক্ষা সামনে আসলেই একশ্রেণির চক্র বেশ সক্রিয় হয়ে উঠে প্রশ্নফাঁস করার জন্য। এই চক্রটি নানা কায়দায় প্রশ্নফাঁস যেমন করে, তেমনি গুজব ছড়িয়ে পরিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিভ্রান্তও করে। শিক্ষাখাতের ক্যানসার হিসেবে বিবেচিত এসব প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রকে নির্মূল করতে কাজ করছে পুলিশ।
তিনি বলেন, দেশের মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় নিয়মিত প্রশ্নফাঁসকারী সিন্ডিকেটের তথ্য পেয়েছেন সিআইডির সাইবার পুলিশ কর্মকর্তারা। ২০২০ সালে মিরপুর মডেল থানায় করা এক মামলায় স¤প্রতি চক্রের অন্তত ৮০ জন সক্রিয় সদস্য প্রায় ১৭ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে অবৈধ উপায়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে। প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পেয়েছে সিআইডি। এর মধ্যে অনেকে পাশ করে চিকিৎসা পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন।
অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, গত ৩০ জুলাই থেকে ১০ দিন ঢাকাসহ টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল জেলায় অভিযান পরিচালনা করে এ চক্রটির ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে ৭ জনই ডাক্তার। তাদের সবাই বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্নফাঁস করতেন।
তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভ‚ইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়েরি উদ্ধার করা হয়েছে। যেখানে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের নাম রয়েছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সিআইডি প্রধান বলেন, মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রে রয়েছেন চিকিৎসক স্বামী-স্ত্রী। স্বামী চিকিৎসক ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ফেইম নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। এর মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অবৈধভাবে শত-শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। প্রশ্নফাঁস ও মানি লন্ডারিং মামলার আসামি ময়েজ ও তার স্ত্রী সোহেলী জামান প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য। তিনি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ফেইম নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে স্বামী ময়েজের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান তিনি।
সিআইডি প্রধান বলেন, ২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান গ্রেফতার চিকিৎসক মো.আবু রায়হান। প্রাইমেট কোচিং সেন্টার চালাতেন। কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রাকটিস করেন। আরেক চিকিৎসক জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮) স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে থ্রি-ডক্টরস নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন।
প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে শোভন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালে র্যাবের হাতে একবার গ্রেফতারও হয়েছিলেন। এছাড়া গ্রেফতার চিকিৎসক মো. জোবাইদুর রহমান জনি (৩৮) মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রে জড়িত।
সিআইডি প্রধান জানান, চিকিৎসক জিলুর হাসান রনি (৩৭) জাতীয় পঙ্গু হাসপাতাল (নিটোর) একজন চিকিৎসক।
২০১৫ সালের মেডিকেল পরীক্ষার সময় র্যাবের হাতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে রংপুর থেকে গ্রেফতার হন। গ্রেফতার চিকিৎসক
ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২) পিতা আব্দুল কুদ্দুস সরকারের মাধ্যমে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। বেসরকারি কমিউনিটি ব্যাজড
মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে পাশ করেন।
তিনি বলেন, গ্রেফতার হওয়া জহিরুল ইসলাম ভুইয়া মুক্তার (৬৮) মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হোতা জসীম এর বড় ভাই ও
স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরো প্রেসের মেশিনম্যান সালামের খালাতো ভাই। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। রওশন আলী হিমু (৪৫) চক্রের হোতা জসীমের ঘনিষ্ট বন্ধু রওশন আলী হিমু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
২০০৬ সাল থেকে মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিমু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।আক্তারুজ্জামান তুষার (৪৩) মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্য। ২০১৫ সালে রাবের হাতে একবার গ্রেফতারও হয়েছে। জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী (৪৫) মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসিমের পুরোনো সহচর। গ্রেফতার আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩) মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের হোতা জসীমের ঘনিষ্ঠ সহচর। ২০০৬ সালে মেয়ে কামরুন নাহার কলিকে ভর্তির মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান। এরপর ছেলে ইমরুল কায়েস হিমেলকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন প্রশ্নফাঁসের এক সিন্ডিকেট।#