ঈমানের দিক দিয়ে সবাই সমান নয়। ঈমানদারদের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। তবে শক্তিশালী মুমিন অধিক উত্তম এবং আল্লাহর
নিকট অধিক প্রিয়। তবে দুর্বল মুমিনরাও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে অধিক উত্তম এবং আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। আর সবকিছুতেই কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং যাতে তোমার কল্যাণ রয়েছে তা অর্জনে আগ্রহী হও এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা কর। দুর্বলতা প্রদর্শন করো না। তবে যদি তোমার কোন কাজে কিছু ক্ষতি সাধিত হয়, তখন তুমি এভাবে বলো না যে, ‘যদি আমি কাজটি এভাবে করতাম তাহলে আমার এই এই হত।’ বরং বল, ‘আল্লাহ এটাই তকদীরে রেখেছিলেন। আর তিনি যা চান তা-ই করেন।’ কেননা যদি শব্দটি শয়তানের কাজের পথকে উন্মুক্ত করে দেয়।” [মুসলিম, মিশকাত হা/৫২৯৮]
একজন শক্তিশালী মুমিনের কী গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য থাকে যার কারণে সে আল্লাহর আল্লাহর অতি প্রিয় হন, সে সম্পর্কে জেনে
নেওয়া যাক…
সুদৃঢ় ঈমান
মুমিন মানেই অটুট আকীদা ও বিশ্বাসের অধিকারী। সে রব হিসেবে আল্লাহর প্রতি, দ্বীন হিসেবে ইসলামের প্রতি এবং নবী হিসেবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সন্তুষ্ট। সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিষয়ে এমন সুদৃঢ় ঈমান পোষণ করে যে, কোন সংশয় ও ভ্রান্তির সামনে দুর্বল হয় না। সে তার মূল্যবোধ ও মূলনীতিতে আস্থাশীল। যার কারণে সংশয় ও সন্দেহের ঝড় তাকে টলাতে পারে না বা কু প্রবৃত্তি ও লালসার স্রোত তরঙ্গ তাকে ভাসিয়ে নিতে পারে না।
সবর বা ধৈর্য ধারণ
মুমিনদের অন্যতম গুণ হল, তারা হন প্রচণ্ড ধৈর্যশীল। শক্তিশালী মুমিন সামাজিকভাবে মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করে আর মানুষ তাকে আচরণে কষ্ট দিলে ধৈর্যের পরিচয় দেয়। এ অবস্থায় ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে চলাফেরা-উঠবস অব্যাহত রাখা একমাত্র শক্তিশালী মুমিন দ্বারাই সম্ভব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে মুমিন মানুষের সঙ্গে উঠবস করে এবং তারা কষ্ট দিলে তাতে ধৈর্য ধারণ করে সে অধিক প্রতিদানের অধিকারী হবে।” [ইবনে মাজাহ, সহীহ-আলবানী, হা/৩২৭৩]
সবর বা ধৈর্যের তিনটি ক্ষেত্রে রয়েছে। যথা- ইবাদত বা আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্য ধারণ, আল্লাহর অবাধ্যতা বা পাপাচার থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ, জীবনের বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা, বিপর্যয় ও দুর্বিপাকে ধৈর্য ধারণ। প্রকৃতপক্ষে দৃঢ় সংকল্প আর মানসিকভাবে শক্তিশালী লোকেরাই কেবল এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। পক্ষান্তরে দুর্বলরা হয় ধৈর্যহীন ও অস্থির। তারা বিপদে পড়লে খেই হারিয়ে ফেলে।
রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা
শক্তিশালী মুমিন তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। সে কখনও ব্যক্তি স্বার্থে রাগ করে না। কেউ তার প্রতি অবিচার করলে প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকার পরও সে ক্ষমা করে দেয়। তবে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘিত হলে বা অন্যায়-অপকর্ম দেখে মনে রাগ সৃষ্টি হওয়া অবশ্যই প্রশংসনীয় গুণ। অন্যায়, দুর্নীতি ও পাপাচারের পথ রোধ করতে এ রাগ অত্যন্ত জরুরি। যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা
শক্তিশালী মুমিন হৃদয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করে। তার স্বপ্ন হয় অনেক উঁচু। তার অভীষ্ট লক্ষ হয় বহু দূর। সে আখিরাতের প্রতিযোগিতায় বিজয় মুকুট পরিধান করতে চায়। শক্তিশালী ঈমান ছাড়া এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার সম্ভব নয়। এ জন্য অনেক ত্যাগ শিকার করতে হয়। অনেক পরিশ্রম আর কষ্ট করতে হয়। যেমন শীতের রাতেও ওযু করে ফজর সালাতে যাওয়া, রাত জেগে কুরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদের সালাত, নফল রোযা, নিজের অভাব থাকা সত্যেও অসহায় মানুষের সাহায্য, কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে দ্বীনের পথে টিকে থাকা, প্রয়োজনে আল্লাহর পথে নিজের জান-মাল সর্বস্ব অকাতরে বিলিয়ে দেয়া ইত্যাদি।
উদ্যমী হওয়া
শক্তিশালী মুমিনের অন্যতম সেরা গুণ হল, তাঁর অন্তরে প্রচণ্ড উদ্যম ও স্পৃহা কাজ করে। সে কখনও অলসতাকে সুযোগ দেয় না। কেননা অলসতাকে আশ্রয় দেয়া মানে, শয়তানের নিকট নিজেকে সঁপে দেয়া। যে নিজেকে শয়তানের কাছে সঁপে দেয় তার ধ্বংস অনিবার্য। সামগ্রিকভাবে অকর্মণ্যতা, অলসতা, ভীরুতা ইত্যাদি দোষগুলো মানুষের উন্নতির পথে অন্তরায়।
নিজের সংশোধনের পাশাপাশি অন্যের সংশোধনের প্রচেষ্টা থাকা
শক্তিশালী মুমিন কেবল নিজের সংশোধনকেই যথেষ্ট মনে করে না। বরং আল্লাহ তাকে যে শক্তি ও সামর্থ্য দিয়েছে তা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে অন্যকেও সংশোধনের কাজে ব্রতী হয়। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি : ‘তোমাদের কেউ যখন কোন খারাপ কাজ হতে দেখবে তখন সে যেন তা হাত দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়। যদি সে এ সামর্থ্য না রাখে তাহলে যেন মুখ দিয়ে পরিবর্তন করে (মুখে প্রতিবাদ করে)। যদি এ সামর্থ্যও না থাকে তাহলে অন্তরে (ঘৃণা করে এবং পরিবর্তনের পরিকল্পনা আঁটতে থাকে), আর এটি হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতর স্তর।’ [সহীহ মুসলিম]
মানুষের উপকার করা
শক্তিশালী মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট হল, সে শুধু নিজের স্বার্থ নিয়েই ভাবে না বরং মানুষের কল্যাণে অবদান রাখে। সে আর দশজন মানুষের মত নয়। সে বিপদে মানুষকে সাহায্য করে, অন্ধকারে আলো জ্বালায়, জ্ঞানহীনকে জ্ঞানদান করে, রোগীর সেবা করে, কেউ পরামর্শ চাইলে সুপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে, মাজলুমকে রক্ষা করে, দু:শ্চিন্তাগ্রস্থ মানুষের মনে সান্ত্বনা দেয়, হতাশার অন্ধকারে আশার আলো জ্বালায়। এভাবে যেখানে যতটুকু সম্ভব সেখানে ততটুকু মানুষের কল্যাণে নিজের মেধা, যোগ্যতা, অর্থ ও শ্রম দ্বারা উপকার করতে ছুটে যায়। এটি হল শক্তিশালী মুমিনের পরিচয়।
দ্বীনের ইলম অর্জন করা
শক্তিশালী মুমিনের অন্যতম গুণ হল, সে দ্বীনের জ্ঞানার্জনে উদগ্রীব থাকে। কেননা ইলম ছাড়া যথার্থ শক্তিশালী মুমিন হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, “বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে?” [সূরা যুমার: ৯]
আল্লাহ তাআলা যাকে ঈমানের পাশাপাশি ইলম দান করেছেন সে নি:সন্দেহে মর্যাদার দিক দিয়ে উন্নত। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও যাদেরকে ইলম দেওয়া হয়েছে আল্লাহ্ তাদের স্তরে স্তরে মর্যাদায় উন্নীত করবেন।” [সূরা মুজাদিলা: ১১]
সুস্বাস্থ্য
একজন সুস্থ, সবল ও মজবুত মানুষ দ্বারা যেভাবে দ্বীন ও দুনিয়ার কাজ করা সম্ভব দুর্বল ও অসুস্থ মানুষ দ্বারা কখনো তা সম্ভব নয়। তাই তো দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মুমিন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে সুস্থ থাকার জন্য দুআ করতেন, রোগ হলে চিকিৎসা করতেন এবং লোকদেরকে চিকিৎসা করাতে উৎসাহিত করতেন। শুধু তাই নয় রবং নিজেও রোগব্যাধির প্রেসক্রিপশনও দিতেন।
সুস্থতার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “দুটি নেয়ামতের বিষয়ে অধিকাংশ মানুষ অসর্তক ও প্রতারিত। সে দুটি হল- সুস্থতা এবং অবসর সময়।” [সহীহুল বুখারী ৫/২৩৫৭]
শারীরিক শক্তি আল্লাহ তায়ালার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। তাই তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঁচটি অমূল্য সম্পদ হারানোর পূর্বে এগুলোর কদর করার কথা বলেছেন। তাই তিনি জীবনকে মৃত্যু আসার আগে, সুস্থতাকে অসুস্থ হওয়ার আগে, অবসর সময়কে ব্যস্ততা আসার আগে, যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে এবং সচ্ছলতাকে দরিদ্রতা আসার আগে মূল্যায়নের কথা বলেছেন।
মজবুত চিন্তাভাবনা ও সুনিপুণ পরিকল্পনা
মজবুত ঈমানদারের একটি গুণ হল তাঁর চিন্তা-চেতনা, কথা-বার্তা, বক্তব্য, সিদ্ধান্ত, যুক্তি, বিচার-বিবেচনা ইত্যাদি সব কিছু হয় মজবুত এবং সূক্ষ্ম। সে ইবাদত-বন্দেগী, কাজে-কর্ম সকল ক্ষেত্রেই সুদৃঢ়, সুনিপুণ এবং যত্মশীল থাকে। মজবুত কাজকে আল্লাহ তাআলাও পছন্দ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “যখন তুমি দৃঢ়ভাবে ইচ্ছা করবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ ভরসাকারীদের ভালবাসেন।” [সূরা আল ইমরান: ১৫৯]
সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে নির্ভীক
মুমিন ব্যক্তি সত্য, ন্যায়-নীতি, সততার পক্ষে থাকে নির্ভীক। এ ক্ষেত্রে সে সমালোচনাকারী কিংবা সমালোচনাকে পরোয়া করে না। বাতিলের বিরুদ্ধে থাকেন ইস্পাত কঠিন। সে হয় সৎ ও কল্যাণকামী। তোষামোদি ও ছলচাতুরীকে কখনই প্রশ্রয় দেয় না। যে দিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা ধরে না বরং সৎ সাহস বুকে নিয়ে নির্ভিকভাবে ঝড়ের বিপরীতেও পথ চলে। এই সাহসী ব্যক্তিরাই সমাজের অন্যায়, অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
আত্মমর্যাদা ও পরিচ্ছন্ন অন্তর
শক্তিশালী মুমিন হয় আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ও পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী। সে অহঙ্কার করে না বরং বিনয় ও নম্রতা তার চরিত্রের ভূষণ। সে অর্থলিপ্সু বা লোভাতুর হয় না। সে হীন চরিত্রের অধিকারী নয়। অর্থের প্রয়োজন হলেও তার আত্মমর্যাদা তাকে অর্থলিপ্সু বানায় না। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যাদেরকে মনের লিপ্সা থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম।” [সূরা আল হাশর: ৯]
মুমিনের হৃদয় হয় ভালবাসা, দয়া ও মায়া–মমতায় পূর্ণ
শক্তিশালী মুমিন কৃতজ্ঞ চিত্তের অধিকারী। সে কারও প্রতি ব্যক্তিগত কারণে ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে না বরং সে কাউকে ভালবাসলে বা ঘৃণা করলে তা হয় একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে কেন্দ্র করে। মুমিনের হৃদয় সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে ময়া-মমতা দিয়ে ভালবাসে।
ভুল স্বীকার করা
শক্তিশালী ঈমানদারের একটি গুণ হল, ভুল হলে সে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে। ভুল সংশোধন করে। সে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে না। এটি সম্মানিত ব্যক্তিদের গুণ।
আমরা যারা এই গুণগুলো এখনও অর্জন করতে পারিনি, তবে চেষ্টা করলে অবশ্যই আল্লাহ তওফিক দান করবেন।