দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক:
দেশের বহুল আলোচিত মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অবৈধ উপায়ে লোক নিয়োগ এবং অতিরিক্ত বেতন ভাতার নামে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আতাউর রহমান ও উপ-সহকারী পরিচালক আফনান কেয়ার নেতৃত্বে একটি টিম অনুসন্ধানের স্বার্থে ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় এবং লোজ নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র চেয়েছেন।
এ বিষয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, যে কোনো অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে কমিশন থেকে অনুমোদন দেওয়ার পর অনুসন্ধান শুরু হয়। দুদক আইন ও বিধি অনুসরণ করে আইনি ব্যবস্থা নেবে। এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) যুগ্ম পরিচালক এবং এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির প্রধান বিপুল চন্দ্র সরকার গণমাধ্যমকে বলেন, মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া সর্বশেষ ১৭৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে আইডিয়ালের অ্যাকাডেমিক, প্রশাসনিক, আর্থিক ও নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি আনা হয়েছে।
অবৈধ ভর্তি নিয়ে আলাদা একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমার দেওয়ার কাজ চলছে। কত সংখ্যক শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে ভর্তি করানো হয়েছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। খুব সতর্কতার সঙ্গে সব নথিপত্র যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
সূত্র মতে, এরআগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়ম,দুর্নীতি এবং শত শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদনসহ চিঠি পাঠিয়েছে দুদকে। ওই চিঠিতে অভিযোক্তদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় রেকর্ডপত্র চেয়ে দুদকের পক্ষ থেকে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান সরকারের স্বাক্ষরে পাঠানো চিঠিতে ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল ও বিভিন্ন শাখার অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকদের দায়িত্ব ভাতার নামে কত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ৩৯০ শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে।
সূত্র মতে, উক্ত প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের বরাবর পাঠানো দুদকের চিঠিতে ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা কী পরিমাণ ছুটি ভোগ করেছেন এবং ছুটি ভোগ করে না থাকলে তার পরিবর্তে টাকা গ্রহণ করেছেন কি না, তার বিবরণ। একই সময়ে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের খাত ভিত্তিক আয়, ব্যয় ও স য়ের অডিট রিপোর্টসহ বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, নিয়োগ সংক্রান্ত যেসব নথিপত্র চাওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে নিয়োগ করা শিক্ষকদের নাম, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কপি ও নিয়োগ সংক্রান্ত রেজুলেশনের কপি। প্রতিষ্ঠানের কোন শ্রেণিতে কতটি করে শাখা রয়েছে এবং এসব শাখা খোলার অনুমোদনের কপি। ২০১১ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডিতে দায়িত্ব পালনকারীর সদস্যদের নাম ও ঠিকানার বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে নৈমিত্তিক ছুটি ভোগ না করায় তিন শাখার শিক্ষক-কর্মচারীরা মোট ২০ কোটি ৫৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮৪৮ টাকা সম্মানী নিয়েছেন। এর মধ্যে মতিঝিল শাখার বাংলা ভার্সনে ৭ কোটি ১২ লাখ ৭০ হাজার, মতিঝিল কলেজ শাখায় দুই কোটি ৩২ লাখ ১৬ হাজার টাকা, বনশ্রী বাংলা ভার্সনে ৫ কোটি ৭৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা, মুগদা বাংলা ভার্সনে তিন কোটি নয় লাখ ৫১ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। গভর্নিং বডির মিটিংয়ে সম্মানী হিসেবে সভাপতি ২৫ হাজার, সদস্য ৬ হাজার এবং অফিস সহকারী তিন হাজার টাকা করে নিতেন। এ ছাড়া, যোগ্য হওয়ার আগেই পদোন্নতি দিয়ে ৫২ কোটি টাকা আত্মসাৎ, টেন্ডার ছাড়াই নগদ খরচ করা হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা এবং এফডিআরের ৭০ কোটি টাকার লাভ নিজেদের পকেটে পুরেছেন চক্রের সদস্যরা।
সূত্র মতে, মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত এক দশকে প্রতিষ্ঠানের নানা খাতে ব্যয় দেখিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও লুটপাট করা হয়েছে। এর পেছনের কারিগর হিসেবে সাবেক অধ্যক্ষ, গভর্নিং বডির সভাপতি, সদস্য ও এক সহকারী প্রকৌশলীর নাম এসেছে। মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া সর্বশেষ ১৭৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে আইডিয়ালের অ্যাকাডেমিক, প্রশাসনিক, আর্থিক ও নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়গুলো আনা হয়েছে। অবৈধ ভর্তি নিয়ে আলাদা একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমার দেওয়ার কাজ চলছে। খুব সতর্কতার সঙ্গে সব নথিপত্র যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে মতিঝিল, মুগদা ও বনশ্রী, এ তিন শাখায় কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগ যাচাই-বাছাই করে ৩৯০ শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ বলে বিবেচিত হয়েছে। যার মাধ্যমে শত কোটি টাকার বেশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া, ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানের মূল শাখা মতিঝিলে ২৩১ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে মানা হয়নি সরকারি নীতিমালা। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে গভর্নিং বডি (জিবি) নিজেদের ইচ্ছা মতো নিয়োগ দিয়েছে। রয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনেরও অভিযোগ।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৯ শিক্ষক এবং ২০২১ সালে আরও ৬৯ শিক্ষককে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব শিক্ষক গড়ে পৌনে তিন লাখ থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা বেতন-ভাতা নিয়েছেন। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালে মুগদা শাখায় শিক্ষক-কর্মচারী মিলিয়ে ৩৮ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই সময়ে বনশ্রী শাখায় ৬৯ জনকে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বনশ্রী বাংলা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ বোর্ডে মাউশি অধিদপ্তরের প্রতিনিধি না থাকায় তার নিয়োগও অবৈধ বলে মনে করছে তদন্ত কমিটি
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশিরভাগ শিক্ষকের নিবন্ধন সনদ নেই। কারো কারো রয়েছে জাল সনদ। এভাবে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় শত কোটি টাকা বেতন-ভাতা নিয়েছেন। যেহেতু অবৈধ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ, তাই বিষয়টি প্রমাণিত হলে বিধিবহির্ভূতভাবে নেওয়া বেতন-ভাতা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে হবে বলেও জানা গেছে। জানা যায়, ২০১১ সালে মার্চ মাসে অতিরিক্ত ৪২ শিক্ষকসহ ১১১ শিক্ষক-কর্মচারীকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও তাদের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন দেওয়া হচ্ছে। নিয়োগপ্রাপ্ত অনেকেরই নেই নিবন্ধন সনদ।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৯ শিক্ষক এবং ২০২১ সালে আরও ৬৯ শিক্ষককে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব শিক্ষক গড়ে পৌনে তিন লাখ থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা বেতন-ভাতা নিয়েছেন। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালে মুগদা শাখায় শিক্ষক-কর্মচারী মিলিয়ে ৩৮ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই সময়ে বনশ্রী শাখায় ৬৯ জনকে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বনশ্রী বাংলা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ বোর্ডে মাউশি অধিদপ্তরের প্রতিনিধি না থাকায় তার নিয়োগও অবৈধ বলে মনে করছে তদন্ত কমিটি।
আরও অভিযোগ রয়েছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম ও প্রতিষ্ঠানটির উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খানের বিরুদ্ধেও পৃথক একটি অনুসন্ধান চলমান। ভিশন- ৭১ ডেভেলপার কোম্পানির মালিক আতিক ও অধ্যক্ষ শাহান আরা মিলেমিশে লুটপাট চালিয়ে নামে-বেনামে একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, আফতাব নগরে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত ১০তলা ভবনের এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের আর্থিক জোগান এসেছে তাদেরই দুর্নীতির টাকায়। যার বর্তমান অধ্যক্ষ শাহান আরা। # একে