দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক :
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, সরকারকে ভ্যাট ও ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে অবৈধ অর্থ অর্জনকারীরা শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন না। অবৈধ সম্পদ অর্জনের পথও সঙ্কুচিত হয়। অনুপার্জিত আয় ভোগ করার প্রবণতা কমে আসবে। দুদকের তদন্ত ও অনুসন্ধানও কিছুটা হলৌ সহজ হয়।
তিনি বলেন, সরকারি ট্যাক্স ফাঁকি মানে অর্থ আত্মসাতের শামিল । আর সরকারি ট্যাক্স আত্মসাতকারী কিভাবে সমাজে মাথা উচু করার সাহস পায় ।
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বিসিএস কর একাডেমি মিলনায়তনে দুদক কর্মকর্তাদের ‘‘আয়কর আইন ও বিধানাবলী” সংক্রান্ত বিশেষ প্রশিক্ষণ কোর্স উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এসব কথা বলেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (কর প্রশাসন) আরিফা শাহানার সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (কর নীতি) মোঃ আলমগীর হোসেন, দুদকের মহাপরিচাল (প্রশিক্ষন ও আইসিটি) একেএম সোহেল, বিস্এিস কর একাডেমির মহাপরিচালক লুৎফুল আজিম প্রমুখ।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের কর আইন সম্পর্কে দুদক কর্মকর্তাদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। এ আইন না জানার কারণে বুঝে না বুঝে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হতে পারেন। তাই দুদক কর্মকর্তাদের আয়কর আইন এমনভাবে জানতে হবে যাতে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার প্রক্রিয়া ও কীভাবে তা রোধ করা যায় এবং এভাবে যারা অনুপার্জিত আয় উপভোগ করছেন তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে প্রকৃত অপরাধীদের আইন আমলে আনতে পারেন।
তিনি বলেন, আয়কর বা যে কোনো করই জনগণের অর্থ। যারা সরকারের এই পাওনা পরিশোধ করেন না । এই পাওনা আসলে -জনগণের অর্থ। সমাজে চলাচল করে তা আমার বোধগম্য নয়। এই আত্মসাৎ নিয়ন্ত্রণ করা দুদকের আইনি ম্যান্ডেট।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুদক কখনও তার ম্যান্ডেটের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করে না, করবেও না। আমরা সবাই একত্রে দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে কাজ করতে চাই। কীভাবে আয়কর না দিয়ে অবৈধ টাকা ঘরে রাখার সাহস পায় । আয়কর বিভাগের সন্দেহ হলে এসব ক্ষেত্রে সার্চ করতে পারে , কি না তা আমাদের জানা নেই । তবে এটা আইনে থাকা উচিত।
তিনি বলেন, আজ যারা ব্যাংক থেকে জাল-জালিয়াতি করে অবৈধভাবে ঋণ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। কর ফাঁকি দিয়ে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করছেন। আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী তাদেরকে তাড়া করছি । শান্তিতে তাদেরকে ঘুমাতে দিব না।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, গভীর রাতে এই রাজধানীতে যাদের ছেলে-মেয়েরা বিলাসবহুল গাড়ি চালাচ্ছেন, শত কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে পালিয়েছেন । অথচ তাদের অনেকের আয়কর রিটার্ন-ই নেই। এটা কিভাবে সম্ভব ? আমরা এটা বন্ধ করতে চাই। এটা চলতে পারে না ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও খুবই হতাশাজনক। বাংলাদেশের মানুষ ১৬ কোটি। আমরা জেনেছি আয়কর রিটার্ন জমা দেন ২০ লাখ আর আয়কর প্রদান করেন মাত্র ১২ লাখ। এটা লজ্জার বিষয়। আমার বিশ^াস যে সব সম্মানিত নাগরিকগণের জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। তাদের প্রত্যেকেরই ট্যাক্স রিটার্ন থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, এতে প্রতিটি নাগরিক নিজেকে দেশের মালিক ভাবতে পারবেন। আর ট্যাক্স রিটার্ন থাকলেই আয়কর দিতে হবে বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। যার আয়করযোগ্য আয় নেই তাকে কোনো আয়কর পরিশোধ করতে হবে না। তবে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হবে। আমরা চাই আয়কর না বাড়িয়ে ট্যাক্সনেট বাড়ানো হোক। এতে প্রতিটি নাগরিকের সম্পত্তির একটি সঠিক হিসাবের ভিত্তিও পাওয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বৈধ/অবৈধভাবে অনেক বিদেশীরা কাজ করছেন। তাদের অনেকেই আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন এবং অবৈধভাবে এই অর্থ পাচারও করছেন বলেও প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায় ।
এক্ষেত্রে আয়কর বিভাগ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার সাথে সমন্বিতভাবে এদেরকে চিহ্নিত করে আয়কর আদায় করতে পারে। যারা এভাবে আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারে।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দেশের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট আদায় করা হলেও সঠিকভাবে সরকারি খাতে জমা হয় না মর্মে প্রায়ই কমিশনে অভিযোগ আসে। ভ্যাট সংগ্রহের ক্ষেেেত্র পাওয় কিছু অভিযোগের কথা উল্লেখ করে
তিনি বলেন, অনেক সময় বিক্রেতা বলেন, ভ্যাটসহ বিল এত টাকা, আর ভ্যাট না দিলে এত টাকা। এটা কীভাবে সম্ভব। মনে হয় এক্ষেত্রে ভ্যাট প্রশাসনের দায়িত্বে কিছুটা শিথিলতা রয়েছে। । আমরা কখনও কখনও শুনি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট আদায়ের ইনফরমাল রসিদ ব্যবহার করে মাসিক ভিত্তিতে তা সংরক্ষণ করা হয় । এটা কিন্ত ভ্যাট আইনের পরিপন্থি বলে মনে হয়।
তিনি বলেন, কমিশন চায় কোনো সৎ ব্যবসায়ী যেন হয়রানির শিকার না হন। কারণ প্রাইভেট সেক্টরই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, কর্পোরেট কর, আয়কর কিংবা ভ্যাট বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের অঙ্গীকার, সততা ও নিষ্ঠাবোধ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতির ন্যূনতম আশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে যা দেখেছি , তাতে অনুধাবন করেছি কোনো মানুষই জোড় করে কারও পকেটে ঘুষের টাকা দিয়ে যায় না। ঘুষ চাইতে হয়। একজন শিক্ষিত কর্মক্ষম মানুষ কীভাবে হাত পেতে ঘুষ চায়। তাই ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনি ক্ষমতার প্রয়োগ অব্যাহত রাখা হবে।
তিনি আরো বলেন, ভ্যাট ও আয়কর প্রদানের ক্ষেেেত্র পদ্ধতিগত জটিলতা কমিয়ে আনা সমীচীন। পদ্ধতিগত জটিলতার আড়ালেই আমাদের কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বেড়ে যায় । পদ্ধতি যতো সহজ হবে আমাদের কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা তত কমে আসবে, দুর্নীতিও কমে আসবে বলে আমার ধারণা।
তিনি বলেন, কীভাবে আয়করের নামে স্ত্রীর কথিত মৎস খামার দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা বৈধ করা হয়। এসব আমরা তদন্তে গিয়ে দেখেছি, একজন ব্যক্তির স্ত্রীর নামে ২ কোটি টাকা মৎস খামারের আয় দেখানো হয়েছে। অথচ বাস্তবে কোনো মৎস খামারের অস্তিত্ব নেই। কথিত মৎস্যখামারের আয় যখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সঠিক মর্মে প্রত্যয়ন করে , তখন দুদকের তদন্তের বিষয়টা কিছুটা হলেও জটিল হয়ে যায়। তাই এ জাতীয় সার্টিফিকেট ইস্যু করার পূর্বে এর সত্যতা যাচাই করা সমীচীনী।
তিনি বলেন সবাইকে মনে রাখতে হবে । আমাদের পূর্বপুরুষগণ যে সংবিধান রচনা করে গেছেন। তার ২০(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘ রাষ্ট্র এমন অবস্থাসৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না-।”
দুর্নীতি দমন কমিশন পবিত্র সংবিধানের বাধ্যবাধকতা অনুসারে – কর ফাঁকি, ভ্যাট ফাঁকি কিংবা ঘুষ দুর্নীতি যে কোনো প্রক্রিয়ায় অনুপার্জিত আয় করে -তা ভোগ করার চেষ্টা করবেন-এসব দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধ করতে দুদক দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
অনুপার্জিত সম্পদ অর্জনকারীদের পিছনে দুদক সব সময় তাড়া করবে। তারা কখনই শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না, তাদের শান্তি কেড়ে নেওয়া হবে। দুদক নিরন্তভাবে তাদের আইনের আওতার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। # কাশেম