বিশেষ প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজারের মনু নদের সেচ প্রকল্পের আওতায় কাশিমপুর পাম্প হাউস পুনর্বাসন প্রকল্পে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে পাম্প ক্রয়ে প্রায় সাড়ে ৩৪ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগের মামলায় আসামীরা দায়মুক্তি পেয়েছেন। ২০২০ সালে দুদকের দায়ের করা মামলাটি টানা ৩ বছর তদন্ত শেষে ৭৮ কোটি টাকার প্রকল্পে কোনো অনিয়ম পায়নি উল্লেখ করে অভিযুক্ত ১১ জনকে ‘দায়মুক্তি’ দিয়েছে দুদক। দুদকের মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ‘প্রকল্পের কাজে কোনো দুর্নীতি হয়নি’। যে কারণে মামলার সব আসামীকে কমিশনের সিদ্ধান্তে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। বিষয়টি এফআরটি’র (ফাইনাল রিপোর্ট ট্রæ) মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়েছে। দুদক থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবরও চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সূত্র মতে, দুদকের মামলা থেকে অব্যাহতি প্রাপ্তরা হলেন- পাউবোর যান্ত্রিক সরঞ্জাম বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী চৌধুরী নাজমুল আলম, পাউবোর পাবনা সার্কেলের তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী ও সাবেক প্রকল্প পরিচালক এস এম শহিদুল ইসলাম, ঢাকা যান্ত্রিক (পাম্প হাউস) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনিছুর রহমান, ঢাকার কেন্দ্রীয় যান্ত্রিক সার্কেলের তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবু তালেব।
ঢাকা যান্ত্রিক (পাম্প হাউস) বিভাগের তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী এম গোলাম সরওয়ার, পাউবোর নকশা সার্কেল- ৩ (যান্ত্রিক) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্বাস আলী, ডিজাইন সার্কেল- ১ ঢাকার তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী মো. আব্দুল বাছিত ও চাঁদপুর যান্ত্রিক উপবিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. রুহুল আমিন এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) প্রকৌশলী সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল, চেয়ারম্যান প্রকৌশলী সৈয়দ আরশেদ রেজা ও মহাব্যবস্থাপক (জেনারেল ম্যানেজার) প্রকৌশলী আব্দুস সালাম।
এদিকে কমিশনের মুখপাত্র (দুদক সচিব) মো. মাহাবুব হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তদন্তে দুর্নীতির সত্যতা না পাওয়ায় আইন ও বিধি অনুসরণ করেই মামলায় উল্লেখিত আসামীদের অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন এবং তত্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই কমিশন থেকে এমন সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তবে এ মামলার বিষয়ে বিস্তারিত জেনে পরে জানানো হবে।
দুদকের সূত্র মতে, ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেন। ওই মামলায় উল্লেখ করা হয়, মনু নদ সেচ প্রকল্পের অধীনে মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরের ২৪ হাজার ১৭৮ হেক্টর এলাকার ১৯ হাজার ২২৮ হেক্টর চাষযোগ্য জমির বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ-ব্যবস্থা প্রদান করার লক্ষ্য নিয়ে কাউয়াদীঘি হাওরের কাশিমপুর পাম্প হাউসে দ্বিতীয়বারের মতো স্থাপন করা হয় নতুন পাম্প মেশিন। এ প্রকল্পে ৮টি পাম্পের মূল্য দেখানো হয় ৫৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। বাস্তবে দুদকের অনুসন্ধানে প্রকৃত মূল্য পাওয়া যায় ২০ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৩৪ কোটি ৪২ লাখ ১৭ হাজার ১০৬ টাকা ২০ পয়সা দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পায় দুদক। যে কারণে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। আসামীদের বিরুদ্ধে দÐবিধি ৪০৯ ও ১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
মামলায় আরও উল্লেখ্য করা হয়, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের এলসির বিপরীতে এনসিসি ব্যাংকের মাধ্যমে ৮টি পাম্পের পরিশোধিত ক্রয়মূল্য ১৭ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার এবং ঠিকাদারের ১৫ শতাংশ লাভসহ মোট ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি ৪১ লাখ ৬০৩ টাকা। ভ্যাট ও আয়কর হিসাবে আসে আরও ৬ কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা। কিন্তু পাম্প ক্রয়বাবদ ৬১ কোটি ৬০ লাখ ৯৫ হাজার টাকার বিল ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রায় সাড়ে ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এরপর টানা ৩ বছরের তদন্ত শেষে কি ভাবে ওই প্রকল্পে দুর্নীতি হয়নি মর্মে অভিযুক্তদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কমিটি দরপত্র যাচাই করে আটটি নতুন পাম্প সরবরাহ, প্রতিস্থাপন এবং স্কাডা সিস্টেম, রিমোট সেন্সিংসহ আধুনিক প্যানেল বোর্ড প্রতিস্থাপনের কাজ সম্পাদনের নিমিত্তে পিপিআর- ২০০৮ এর বিধি ৭৬ (১) (ক) মোতাবেক সরাসরি ক্রয় (ডিপিএম) পদ্ধতিতে সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের অনুক‚লে অনুমোদন জ্ঞাপনের সুপারিশ করা হয়। কোনো প্রকার নিয়মনীতি অনুসরণ না করে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কতিপয় কর্মকর্তা তিনগুণ বেশি দামে কেএসবি পাম্প সরবরাহ নিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছে। অর্থাৎ অনুসন্ধান পর্যায়ে পাম্পের মূল্য, দরপত্র প্রক্রিয়া এবং পাম্প ছাড়াও অতিরিক্ত ব্যয় সংক্রান্ত অনিয়মের তথ্য মেলে।
মামলা দায়েরের আগে দুদকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পাম্পের মূল অংশ কেএসবি জার্মান থেকে আমদানি করা হলেও আনুষঙ্গিক বেশকিছু সরঞ্জাম মূল কেএসবি’র ডিজাইন ও গাইডলাইন মোতাবেক দেশেই তৈরি করা হয়। যেমন- স্পেয়ার জয়েন্ট অ্যাসেম্বল, ডিসকার্স পাইপ, ফ্লেন্জ, নাট-বল্টু ও গ্যাসকেট ইত্যাদি।
অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দাখিল করা পাম্প ক্রয়ে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় দ্বারা সম্পূর্ণ পাম্প সেটের মূল্য নির্ধারণ করে মামলাটি রুজু করা হয়। কিন্তু তদন্তকালে দেখা যায়, আমদানি করা মূল অংশ এবং দেশে প্রস্তুত করা অংশের সমন্বয়ে পাম্পের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া একনেক কর্তৃক অনুমোদিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ঠিকাদার পাম্প ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেন। দুই বছর ধরে ইন্সটলেশন ও কমিশনিং করাসহ অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স করতে বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সমাগম করা হয়েছে। এসব বিবেচনায় রেখে পাম্পের সামগ্রিক মূল্য ৬১ কোটি ৬০ লাখ ৯৫ হাজার ২৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এছাড়া সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড সঠিক সময়ে সঠিকভাবে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করেছে এবং স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পাম্প সরবরাহ করেছে। বর্তমানে পাম্প হাউসটি চালু রয়েছে এবং কাজের মান নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী সঠিকভাবে কাজ সম্পাদনের জন্য বাপাউবো গত ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর কাজ সম্পাদনের সনদ প্রদান করে। চুক্তিপত্রের শর্ত অনুযায়ী পরবর্তীতে সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড আরও দুই বছর স্থাপিত পাম্প, স্কাডা সিস্টেম, রিমোট সেন্সিং প্যানেল বোর্ডসমূহের রক্ষণাবেক্ষণের কাজও যথাযথভাবে সম্পন্ন করে এবং বাপাউবো কর্তৃক ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত একটি সনদ প্রদান করা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১৭ ও ২০১৮ সালের এলসির বিপরীতে এনসিসি ব্যাংকের মাধ্যমে ৮টি পাম্পের পরিশোধিত ক্রয়মূল্য ১৭ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার ও ঠিকাদারের ১৫ শতাংশ লাভসহ মোট ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি ৪১ লাখ ৬০৩ টাকা। ভ্যাট ও আয়কর হিসাবে আসে আরও ৬ কোটি ৭৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা। কিন্তু পাম্প ক্রয়বাবদ ৬১ কোটি ৬০ লাখ ৯৫ হাজার টাকার বিল ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অতিরিক্ত ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। # কাশেম