দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক :
২৭৫ কোটি ৩২ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে পুরান ঢাকায় লালাবাগ এলাকায় মেসার্স নাহিদ এন্টারপ্রাইজের মালিক আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর। সোমবার (৬ ডিসেম্বর) ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরে মেসার্স নাহিদ এন্টারপ্রাইজের মালিক আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মামলায় এ প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে টানা পাঁচ বছর বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে মালামাল খোলা বাজারে বিক্রির মাধ্যমে সরকারের ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। একইসাথে চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি সংক্রান্তে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও আয়কর ফাঁকির অভিযোগ তদন্তের জন্য উদ্যোগ নেয়ার প্রত্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে ভ্যাট আইনে মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সূত্রমতে, নাহিদ এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির একটি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভ্যাট গোয়েন্দা দপ্তরের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেন একটি টিম। নাহিদ এন্টারপ্রাইজের ঠিকানা হলো; ৩৬-৩৭ উমেশ দত্ত রোড, বকশি বাজার, লালবাগ, ঢাকা-১২১১ এবং প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নম্বর- ০০০৩৮১০৯২-০২০৪। আর মালিক আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন, পিতা- কাইয়ুম, মাতা-হামিদা খাতুন, ঠিকানা- ১০/এ, গির্দা উর্দু রোড, পোস্তা, লালবাগ, ঢাকা-১২১১।
ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির একটি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভ্যাট গোয়েন্দা দপ্তরের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেন। গত ২০১৫ সালের জুলাই ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ভ্যাট সংক্রান্ত বারাবার রেকডপত্র (দলিলাদি) চেয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছে চিঠি পাঠা নো হয়।
কিন্তু নাহিদ এন্টারপ্রাইজের পক্ষ থেকে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর থেকে কোন ধরনের রেকর্ডপত্র সরবরাহ করা হয়নি। এমনকি চলমান অনুসন্ধান কার্যক্রমকে সহযোগিতার না করে বারবার সময়ে চেয়ে কালক্ষেপণ করেছে এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক। পরে গত ২০২১ সালে ১৭ জুন ভ্যাট গোয়ন্দা দপ্তরের উপ-পরিচালক তানভীর আহমেদের নেতৃত্বে ওই প্রতিষ্ঠানে ’নিবারক কার্যক্রম’ অভিযান চালিয়ে ভ্যাট সংক্রান্ত বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করা হয়।
অনুসন্ধানে আরো দেখা যায় যে, নাহিদ এন্টারপ্রাইজ অন্যান্য বন্ডেড প্রতিষ্ঠান থেকেও বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত ছিল।এর ফলে চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি সংশ্লিষ্ট মানি লন্ডারিং অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে অনুসন্ধান টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। ভ্যাট গোয়েন্দার টিমের অভিযানে তারা অফিসিয়াল আরো তথ্য পেয়েছেন যে, নাহিদ এন্টারপ্রাইজ মূসক-৬.৩ চালান ব্যতীত সেবা প্রদান করে যথাযথ রাজস্ব পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত বিক্রয় তথ্য অন্যত্র গোপন দলিলে সংরক্ষণ করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছে।
অভিযানকালে ভ্যাট গোয়েন্দার টিমের সদস্যদের সামনে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত এ পাঁচ বছর নাহিদ এন্টারপ্রাইজের দাখিলপত্রে বিক্রয় মূল্য প্রদর্শন করেছে ২৯১ কোটি ৮৯ লাখ ৬৬ টাকা। কিন্তু জব্দকৃত দলিলাদির ভিত্তিতে দেখা যায়, এ প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত বিক্রয়মূল্য ১,৫৪০ কোটি ২৬ লাখ ৬৩ হাজার ২২ টাকা।
যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রয়মূল্য ছিল ১,৩৩৯ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার ১৯ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি ১,০৪৭ কোটি ৪৭ লাখ ১৯ হাজার ৯৫৪ টাকার প্রকৃত বিক্রয়মূল্য গোপন করেছে। বিক্রয়মূল্য কম প্রদর্শন করায় অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ১৫৭ কোটি ১২ লাখ হাজার ৯৯৩ টাকা উদঘাটন করা হয়। যার ওপর মাস ভিত্তিক ২% হারে ১১৮ কোটি ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ২৪২ টাকা সুদসহ মোট ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ২৭৫ কোটি ৩২ লাখ ২ হাজার ২৩৫ টাকা হয়েছে।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, নাহিদ এন্টারপ্রাইজ এ পাঁচ বছরে দাখিলপত্রের মাধ্যমে মোট ভ্যাট পরিশোধ করেছে মাত্র ৪৩ কোটি ৭৮ লাখ ৩৫ হাজার ১০ টাকা। কিন্তু ভ্যাট গোয়েন্দার তদন্তে একই সময়ে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ পাওয়া যায় ১৫৭.১২ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি প্রমাণীত হয়েছে। যে এ প্রতিষ্ঠানটি নানা ধরণের অবৈধ লেনদেনের সাথে জড়িত হয়েছে।
এই তদন্তে প্রতিষ্ঠানের দু’টো ব্যাংক এ্যাকাউন্টে মোট ১,৫৪০ কোটি ২৬ লাখ ৬৩ হাজার ২২ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। অবৈধ বন্ডেড পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের অর্থ এইসব লেনদেনে সংঘটিত হয়েছে মর্মে তদন্তে উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানের নামে পুরান ঢাকায় প্রাইম ব্যাংকের মৌলভিবাজার শাখা ও উত্তরা ব্যাংকের চকবাজার শাখায় দ’টো ব্যাংক এ্যাকাউন্ট রয়েছে।
সূত্র মতে,ভ্যাট গোয়েন্দার অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ভ্যাট ফাঁকির সংশ্লেষে আয়কর ফাঁকির অভিযোগটি আরো গভীরভাবে তদন্ত ও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) কে অনুরোধ করা হয়েছে। অনুসন্ধান ও তদন্তে উদঘাটিত পরিহারকৃত ভ্যাট আদায়ের আইনানুগ পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে মামলাটি সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারেটে প্ররণ করা হয়েছে।
একইসাথে নাহিদ এন্টারপ্রাজের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম আরো মনিটরিং করার জন্যও সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারকে অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যদিকে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ঢাকা বন্ড কমিশনারকেও অনুরোধ করা হয়েছে। #