দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক:
রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন বক্তব্যের শুরুতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেন। তিনি বরেলন, ক্ষুধা, দুর্নীতিমুক্ত এবং সুখী-সমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি, কালোবাজারি ও অর্থপাচারের বিরুদ্ধে জাতির পিতা সবসময় অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নৈতিকতা প্রদর্শন করে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, আপনার বা আপনাদের কোনো ভুল পদক্ষেপে যেন কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
রাষ্ট্রপতি লিখিত বক্তব্যে বলেন, আজ ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করছে। বাংলাদেশ ২০০৭ সালে United Nations Convention Against Corruption (UNCAC) এর অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হবার পর থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করে আসছে। দিবসটি সরকারিভাবে পালনের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান আরও সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় হয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত দুর্নীতিবিরোধী সনদ স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবসময়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য “উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ” অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ হয়েছে বলে আমি মনে করি।
৯ ডিসেম্বর ( শনিবার) দুপুরে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস ২০২৩ উপলক্ষে রাজধানীর সেগুন বাগিচায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে জাতীয় নাট্যশালা অডিটরিয়ামে দুদক আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিতির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন এসব কথা্ বলেন। দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন, দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোছা. আছিয়া খাতুন, কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক।
রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। আমাদের সেই স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো পুনর্গঠনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন- “৭১-এ আমি ঘোষণা করেছিলাম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে হবে। আজ ৭৫ সনে আমি আহ্বান জানাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে হবে”। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক চক্রের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাসহ তাঁর পরিবারের আপনজনদের নৃশংস হত্যাকান্ডের ফলে আবার রুদ্ধ হয় উন্নয়নের সে অগ্রযাত্রা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথ বঙ্গবন্ধু দেখিয়ে গেছেন নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আবারো সেই পথ ধরে এগিয়ে চলছে দেশ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নসহ আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বেড়েছে মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ুষ্কাল। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মিত হয়েছে। নির্মিত হয়েছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। বাস্তবায়িত হয়েছে পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী বহুমুখী টানেল ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্প।
রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আজ অভিজাত স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য। টেকসই উন্নয়নের এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি উন্নত, স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তবে, দুর্নীতি সেই কাঙ্খিত উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা আরো গতি পাবে।
তিনি বলেনৈ, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হলো মানবিক, বৈষম্যহীন, দারিদ্রমু্ক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ। আমাদের পবিত্র সংবিধানও দুর্নীতিকে বারিত করেছে। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না …”। সংবিধানের এ মর্মকে ধারণ করেই দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ প্রনয়ণ করা হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন।
রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৫৬ সালের কোয়ালিশন সরকারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় ও আপসহীন অবস্থানের জন্যই তাঁকে দুর্নীতি দমন বিষয়ক মন্ত্রী করা হয়েছিল। তিনি কখনো দুর্নীতির সাথে আপস করেননি। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। ২১ জুলাই ১৯৭৫ সালে বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “শুধু নিজেরা ঘুষ খাওয়া করাপশন নয়। এ সম্বন্ধে আমার কথা হলো-করাপ্ট পিপলকে সাহায্য করাও করাপশন। নেপোটিজম কিন্তু A type of Corruption.স্বজনপ্রীতিও কিন্তু করাপশন। আপনারা এসব বন্ধ করুন–।”দুর্নীতি শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। দুর্নীতি দমন শুধু আইন এবং দুদকের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, দুদক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব কোনো অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে নির্মোহ ও নিষ্ঠার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে পালনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারলেই আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন স্বার্থক হবে। সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের কাছে দুদকের জবাবদিহি থাকা উচিত।
সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, একজন দুর্নীতিবাজের পরিচয় কেবলই দুর্নীতিবাজ। দুর্নীতিবাজদের কোনো দল নেই, নীতি-আদর্শ নেই। তাই দুর্নীতিবাজরা যে দলেরই হোক, দুর্নীতি করলে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে হলে দুদককে আরও কৌশলী হতে হবে, প্রশিক্ষিত ও প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে।
‘তাই দুর্নীতি দমন করতে হলে পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা এবং ধর্মীয় অনুভূতিও দুর্নীতি রোধে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।’ বলেন সাহাবুদ্দিন।ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলারও তাগিদ দেন রাষ্ট্রপতি।
তিনি ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনে কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় পদ্মা সেতুর অসত্য কেলেঙ্কারির ঘটনাসহ বিভিন্ন স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের সফলতায় আনন্দিত হই, আবার ব্যর্থতায় ব্যথিত হই। দুদকের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে প্রত্যেককে আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
# একে