দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদক:
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আগামী ১৭ ডিসেম্বর বিদেশে অর্থপাচারকারীদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্তসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দুদকের তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে অর্থপাচারকারীদের তালিকা, বিশ্বের কোন কোন দেশে কারা, কিভাবে, কি পরিমাণ অর্থপাচার করেছেন, তার তথ্য-উপাত্ত থাকবে জানা যায়।
ইতোমধ্যে দুদকের একাধিক টিম দীর্ঘদিন ধরে অর্থপাচার নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছেন। মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশেসরেজমিন পরিদর্শন ও অনুসন্ধান করেছেন।
গত ২২ নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে অর্থপাচারকারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত চেয়ে দুদকসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুলসহ আদেশ জারি করেন।
হাইকোর্ট আগামী ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে বিদেশে টাকা পাচারকারীদের নাম-ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য (মামলাসহ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি না) প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে দুদকের চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্রসচিব, পররাষ্ট্রসচিব, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিনানসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও এনবিআরের চেয়ারম্যানকে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশও দেন।
দুদকের লিগ্যাল উইং শাখার কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান গণমাধ্যমকে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে আগামী ১৭ ডিসেম্বর অর্থপাচারকারীদের সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।
সরাসরি অর্থপাচারকারীদের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, অর্থপাচারকারীদের তালিকায় সাবেক মন্ত্রী, এমপি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরিজীবীসহ নানা শ্রেণী-পেশার লোকজন রয়েছেন।
অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান বলেন, আগামী ১২ ডিসেম্বর হাইকোর্টে অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে থাকা এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দিবে দুদক। পিকে হালদারকে গ্রেপ্তার ও তাকে বিদেশ থেকে ফেরাতে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। দুদক পৃথকভাবে এই দুইটি প্রতিবেদনই হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দিবে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারকারীদের বিষয়ে হই-চই শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুুরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর আট হাজার কোটি টাকার সন্ধানের বিষয়টিও রয়েছে। কিন্তু দুদকের কর্মকর্তারা ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান বিষয়টি নিয়ে কৌশলে কথা বলছেন, তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন।
পিকে হালদারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকেই এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন পিকে হালদার।
গত মার্চে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে গত সাত বছরে পাঁচ হাজার ২৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচার করা এই অর্থের বেশিরভাগই হয়েছে আমদানি-রপ্তানিতে জালিয়াতির মাধ্যমে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর বছরে পাচার হয়েছে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। বর্তমান বাজারদরে যা ৬৪ হাজার কোটি টাকা হবে।
অর্থপাচারের ক্ষেত্র পাচারকারীদের পছন্দের গন্তব্য হচ্ছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। কানাডার টরেন্টোর রিচমন্ড এলাকায় বহু বাংলাদেশির বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে, যেগুলোর বেশিরভাগই পাচারের অর্থে কেনা হয়েছে। স্থানটি বাংলাদেশিদের ‘বেগমপাড়া’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
২০১৮ সালের জুনে প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জমানো অর্থের পরিমাণ ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা।
গত ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, গোপনে কানাডার টরেন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশিদের বিষয়ে খোঁজ নেয়া হয়েছে। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়ি-ঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাদের ছেলে-মেয়েরা সেখানে থাকে।
মন্ত্রী বলেন, এমন ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চারজন। কিছু আছেন আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি। পাচারে শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা। তবে তথ্য পাওয়া খুব কঠিন। বিভিন্ন মিডিয়ায় যে তথ্য বের হয়, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, আসলে সংখ্যাটি ততো নয়।’
তিনি বলেন, ‘পাচারের দায় বিদেশি সরকারও এড়াতে পারে না। যেমন সুইজারল্যান্ডের কারা ব্যাংকে টাকা রাখলেন, সেই তথ্য আমাদের দেয় না।’#