দিদারুল আলম দিদার , দূরবীণ নিউজ :
করোনা মহামারি সংক্রমণ প্রতিরোধে নজিরবিহীন পরিস্থিতিতে কুমিল্লায় কয়েকটি এলাকায় চলছে লকডাউন। সরেজমিন লকডাউন কার্যকরে দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবক নামের পিকেটার ও কতিপয় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যসের প্রদর্শিত আচরণে হতবাক বিস্মিত হতে হয় অসহায় মানুষের।
যেখানে এ ক্রান্তিকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশব্যাপী মানবিকতার নিদর্শন দেখিয়ে দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছেন। ঠিক এ মূহুর্তে কুমিল্লার লকডাউন অঞ্চলের প্রবেশদ্বার বাদশামিয়া বাজার এলাকায় কোন পুলিশ সদস্য গতকাল শনিবার দায়িত্বে ছিলেন ! যিনি বা যারা দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক বোনকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থার পরিবর্তে তাকে কয়েক কিলোমিটার এলাকা হাটতে বাধ্য করলেন ! ভয়াবহ নির্মম ও বর্বরোচিত কিছু ঘটলে দায়টা কে নিতো ? প্রশ্ন ভুক্তভোগী মানুষের।
কুমিল্লার রেইসকোর্স এলাকায় ,অসুস্থদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ প্রদর্শন করা এসব কথিত স্বেচ্ছাসেবক নামধারী পিকেটারদের উল্লাসকি থামাবেন কুমিল্লার প্রশাসন? মানবিক স্বেচ্ছাসেবক এখানে দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। কথিক স্বেচ্ছাসেবক নামধারীদের মানবিক হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়ার পরামর্শও দিয়েদিয়েছেন কেউ কেউ !
সাংবাদিক মানবাধীকার কর্মী সুমন সালাউদ্দিন। যিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাদেশ ডট নেট এর একজন সাংবাদিক ও পেশাদার একজন এ্যাংকর। লকডাউনে কুমিল্লার রেইসকোর্সে তার সাথে ঘটে যাওয়া অমানবিকতা ও নির্মমতা তার ফেইসবুক ওয়াল থেকে হুবুহু তুলে ধরা হলো-
“স্বেচ্ছাশ্রম নাকি স্বেচ্ছাচারীতা ?????
নেতিবাচক লেখা আমি লেখিনা খুব একটা । তারপর ও এই লেখাটার শিরোনামটাই নেতিবাচক। জীবনের মধুরতম ফিলিংসগুলির একটা ফিলিংস ধারন করছি এই মূহুর্তে। প্রথম নিজ সন্তানের বাবা হয়েছি। সব ভাবনাই ইতিবাচক হবার কথা। বৃহত্তর ইতিবাচক কিছু হবার প্রত্যাশায় এই নেতিবাচক লেখা। মূল ঘটনায় আসি। আমার স্ত্রী অন্তঃসত্তা ছিল। নরমাল ডেলিভারির অপেক্ষায় ছিলাম।ডাক্তারের দেয়া তারিখ পার হয়েছে ৪ দিন হল।
প্রাকৃতিক নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কোনরকম সার্জারী করার একফোঁটা ইচ্ছা ছিলনা। তাই প্রায় প্রতিদিন ই ডাক্তারের কাছে রুটিন চেকাপের জন্য
নিয়ে যেতে হচ্ছে, বাচ্চার মুভমেন্ট ও হার্টবিট চেক করতে। এর মধ্যে করোনা সংক্রমন ঠেকাতে কিছু রেড জোনে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে প্রশাসন। ভাগ্যের স্রোতে এই জোনে আমিও পড়ে গিয়েছি৷ আজ বেলা 2 টায় ডাক্তারের সাথে এপোয়েন্টমেন্ট ছিল।
যথারীতি বেলা ১ টায় বের হয়ে দেখি লকডাউন জনিত কারনে রাস্তায় কোন যানবাহন নেই। পরিচিত একজন অটোরিকশা চালককে ফোন দিলাম, সে জানালো সব দিকে রাস্তায় বেড়া দেয়া সে আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌছাতে পারবেনা। অগত্যা নিরুপায় হয়ে ১০ মাসের অন্তসত্তা স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটা ধরলাম এবরো থেবরো পথে। রেইসকোর্স এলাকার মফিজউদ্দিন সড়কের কতটা বেহাল দশা তা হয়ত কুমিল্লার অনেকেরই জানা।
সহধর্মিণীর কষ্ট টা আর নিতে পারছিলামনা। কাঠের পুল হয়ে ধানমন্ডি রোডের মাথায় ওকে দাড় করিয়ে আমি ত্রস্ত্র পায়ে হেঁটে গেলাম বাদশামিয়া বাজার মোড়ের দিকে। ওখানে গিয়ে দেখলাম লকডাউনের উৎসব চলছে যেন। ১০ – ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবক উল্লাসে মেতেছে। আর পাশেই কিছু পুলিশ সদস্য দাড়িয়ে আছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সমস্যার কথা জানিয়ে জানতে চাইলাম এখানে টিম লিডার কে, কার সাথে কথা বলব। আমাকে চরকির মত ঘুরালো সবাই মিলে।
পরে মনে হল সব্বাই টিম লিডার। যাই হোক, সকলের কাছে হাত জোর মিনতি করলাম একটা রিকশাকে এলাউ করার জন্য।
মনে হল আমি তাদের বাবার সম্পত্তি চেয়েছি। সবাই যেন ত্যাড়ে এলো। কোন এক বিশেষ কারনে এরা সকলেই অতিরিক্ত রকম উত্তেজিত। পরবর্তীতে একজন পুলিশ সাব ইন্সপেক্টরের কাছে আমাকে পাঠানো হল। এরি মধ্যে আমার স্ত্রী বার বার ফোন দিয়ে যাচ্ছে।
সেই অতি শিক্ষিত পুলিশ সদস্য আমাকে আইন বুঝালো। শুধুমাত্র এম্বুল্যান্স নাকি এলাউ, জেলা প্রশাসকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী । রিক্সা এলাউনা। আমি অবাক হয়ে রইলাম। সাব-ইন্সপেক্টর পদবিটা আমাদের দেশে সম্মানের যতটা না, তার চেয়ে বেশি ক্ষমতার।
এতটা ক্ষমতাবান ব্যাক্তি এম্বুলেন্স শব্দটার মানে বুঝেনা, তা জেনে সত্যিই অবাক হলাম। এরা কিভাবে এতগুলো এক্সামে উত্তির্ন হয়ে একজন সরকারি অফিসার হয় তা আমার সরল মনে বোধগম্য হলনা। তাকে বুঝাতে চেস্টা করলাম এম্বুলেন্স শব্দটার মানে কি।
তাকে ভেংগে বল্লাম যে অফিসার, এম্বুলেন্স হবার জন্য একটা মাইক্রোবাস হবার বাধ্যবাধকতা নেই। একটা নৌকাও এম্বুলেন্স হতে পারে, একটা ভ্যান, একটা রিকশা, একটা অটো রিক্সা, একটা পাল্কি, একটা বিমান সহ যেকোন যানবাহন যদি জরুরি রোগী পরিবহনের কাজে নিয়োজিত থাকে সেটাই এম্বুলেন্স। অফিসার মহোদয়ের ইগুতে লাগলো বিষয়টা, কেন আমি তাকে বুঝাতে গেলাম। এর আগেও এক পুলিশকে আইন বুঝাতে গিয়ে জেল খেটেছি ৩ দিন। এই পরিস্থিতিতে আর ঘাটাতে যাইনি।
যা বলছিলাম, অবশেষে সে অফিসার আমাকে একটা মাইক্রোবাস এম্বুলেন্সের ফোন নাম্বার দিয়ে দিলেন। আমি নিরুপায় হয়ে সে এম্বুলেন্সকে কল দিয়ে ভাড়া জানতে চাইলাম। জানতে চাইলাম বাদশা মিয়ার বাজারের মোড়ে আসতে তার কতক্ষণ লাগবে।
ড্রাইভার সাহেব জানালেন ৩০ মিনিট সময় লাগবে। একজন বাংলাদেশি হিসেবে ৩০ মিনিট সময়টা প্রকৃতপক্ষে ১ ঘন্টার কাছাকাছি হয়ে আমার এন্টেনাতে ধরা পড়লো। তারপর 2 কিলোমিটার রাস্তার ভাড়া ১০০০ টাকা শুনে সেই মহান এম্বুল্যান্স নেবার চিন্তা একেবারেই নাকোচ করে দিতে হল।
কারন প্রতিদিন এত টাকা এম্বুলেন্স ভাড়া দেবার মত এবিলিটি সত্যিই আমার নেই। আর এদিকে দেশসেবার ব্রত নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী দল ও পুলিশ সদস্যরা তাদের নিজেদের তৈরি আইনের প্রতি অনেক বেশি কঠোর হয়ে বসে আছেন।
নো কম্প্রোমাইজ!! আমার মনে কিঞ্চিত ভাবনা এলো, ইশ!! এইভাবে যদি উনারা সবসময় আইন প্রতিষ্ঠায় কঠোর থাকতেন!! আমি প্রায় ৩০ মিনিটের মত সময় ওখানে কাটিয়েছি। আমি বহুবছর ধরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছি। সমাজে আমার প্রথম পরিচয় আমি একজন স্বেচ্ছাসেবী। একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আমার উপলব্ধির যায়গাটা যেটা হয়েছে, তাদের স্বেচ্ছাশ্রমটা যেন একটা উৎসব!
ক্ষমতা প্রদর্শন
মানুষকে আটকে দেবার ক্ষমতা তাদের হাতে। একটা পাশবিক আনন্দ নেবার জন্যই কাজটা করছে, এর বেশিকিছু নয়।। ইতিমধ্যে আমি কুমিল্লার NDC সাহেবকে ফোন দিয়ে বিষয়টা অবিহিত করলাম। তিনি ব্যবস্থা নিবেন বলে আশ্বাস দিলেন। তারপর এলাকার নির্বাচিত কাউন্সিলরকে কল দিলাম তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
দু-চারজন সাংবাদিক বন্ধুকে বিষয়টি জানালাম। তখন ব্রেইনের একটা নিউরন ও যেন ঠিকভাবে কাজ করছিলনা। অনেককেই কল দিয়েছি একটু হেল্প পাবার জন্য। আমার লব্ধঘর্ম পরিস্থিতি দেখে সেই দেশপ্রেমিক ভলেন্টিয়ার ও পুলিশ গুলি দূর থেকে বিজয়ের আনন্দ নিচ্ছিলো।
শেষমেশ আমার স্ত্রী একটি মানব সন্তানকে গর্ভে নিয়ে সেই পথটুকু হেঁটে এলো বাদশামিয়ার বাজারের মোড় পর্যন্ত । তার প্রতিটি কদম যেন যন্ত্রনার এক বিষফোঁড়া হয়ে ধরা দিচ্ছিলো। যন্ত্রনায় কাতর শরিরের ভাষা স্পষ্ট প্রতিয়মান। আমি দূর থেকে অসহায়ের মত তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে।
একজন অপারগ স্বামীর চোখের কোণা বেয়ে দুফোঁটা জল পড়েছিল গড়িয়ে। জীবনে এই প্রথমবার একজন অক্ষম মানুষকে আয়নাটাতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আরো ২ একটা দিন ওয়েট করলে, নরমাল ডেলিভারির চান্স ছিল। কিন্তু মহান স্বেচ্ছাসেবী টিমটাকে আরো দুইদিন ফেইস করতে হবে এবং আমার স্ত্রীকে দীর্ঘ এই পথ হাটতে হবে ভেবে আজই সার্জারীর মাধ্যমে শিশুটিকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হল।
সবশেষে সুধি মহল ও কুমিল্লার নেতৃত্বস্থানিয় মানুষদের কাছে প্রশ্ন একটাই, এই স্বেচ্ছাশ্রম কতটা মনবিক???”
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস জনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশ ও বিশ্বে নজিরবিহীন অবস্থা বিদ্যমান। আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল চলছেই। এ সময়ে সকলে সর্তকতা অবলম্বনের পাশাপাশি আরো মানবিক হবো এটাই সময়ের দাবী। # কাশেম
খুবি ব্যথিত হলাম!!!