দূরবীণ নিউজ প্রতিবেদন:
করোনা ভাইরাস ও কথিত ওষুধ আবিস্কার নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি চলছে। শুধু তাইনয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পেসবুকে এবং কিছু কিছু গনমাধ্যমেও করোনার ওষুধ নিয়ে নানা ধরনের লোভনীয় তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। আর এই বিষয়টি নিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মুহিদ ইসলাম একটি প্রতিবেদন লিখেছন। তার প্রতিবেদনটি হুবহু নিম্মে প্রকাশ করা হলো:
মো. মুহিদ ইসলাম সহজ সরল ভাষায় বিষয়টি উপস্থাপন করছেন। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, নোয়াখালী অঞ্চলে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে। প্রবাদটি হলো- ঠাডা হড়ি বগা মরে, হৈরা কেরামতি ঝাড়ে। (ঠাডা=বজ্রপাত, হড়ি=পড়ে, বগা=বক, হৈরা=ফকির)। এই প্রবাদটি বাংলাদেশের মিডিয়া, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা জগতে এখন স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি স্বার্থান্বেষী মহল কভিড ১৯ চিকিৎসায় কার্যকর বলে মিডিয়ার মাধ্যমে একের পর এক ওষুধকে কার্যকর বলে জোর করে সামনে ঠেলে দিয়ে যেভাবে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে- তা মোটেই প্রশংসনীয় নয়, বরং অজ্ঞতা ও প্রতারণার সামিল। আগেও নানা ওষুধ নিয়ে মিডিয়াতে স্টান্টবাজি হয়েছে। এখনো সমান তালে চলছে।
প্রথমদিকে ক্লোরোকুইন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকারিতা নিয়ে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকঢোল পেটানো ও শোরগোলকে আমি বোগাস, অবান্চিত ও বিভ্রান্তিকর বলে স্ট্যাটাস লিখেছিলাম। আমি এ-ও লিখেছিলাম যে ক্লোরোকুইন ফসফেট খেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় করোনায় আক্রান্ত এক ব্যাক্তি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর স্ত্রী মৃতপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন।
তারপরও আশ্চর্যের ব্যাপার- কোনো কিছু চিন্তাভাবনা না করেই ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কয়েকটি কোম্পানিকে ঝোঁকের বশেই আটটি কোয়েশ্চেনেবল ওষুধের উৎপাদনের অনুমতি দিয়ে ফেললো। ফলাফল কী হলো? যা হবার তাই হলো। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়লো, গাড়ি উল্টোদিকে ছুটলো।
শেষ পর্যন্ত আমার বক্তব্যই সত্য বলে প্রমাণিত হলো। আমি বলছিলাম- করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে এসব ওষুধ প্রয়োগ বিপদ ডেকে আনতে পারে। এখন সর্বত্র বলা হচ্ছে- করোনা রোগীরা ম্যালেরিয়ার এই ওষুধ গ্রহণ করলে রক্ত জমাটের কারণে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করতে পারে। তারপর একের পর এক ওষুধ এল আর গেল। একটারও যথাযথ কার্যকারিতা প্রমানিত হলো না। কিন্তু ঢাক-ঢোল পেটানো বন্ধ হলো না। চলতেই থাকলো।
কয়েকটি অসম্পূর্ণ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল নিয়ে কিছু দিন জাপানের অ্যাভিগান নিয়ে বেশ উত্তেজনা দেখা গেল। তখনও আমি একটি মিডিয়াকে বলেছিলাম- এই ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে এখনই কিছু বলার সময় হয়নি। এ ওষুধ কার্যকর হবে বলে আমার মনে হয় না।
তারপর এল রেমডেসিভির। বলা হলো – ওষুধটি আশাপ্রদ ও করোনা চিকিৎসায় কার্যকর হতে পারে। কার্যকর হতে পারা আর কার্যকর হয়ে যাওয়ার পার্থক্য কী রেগুলেটরি অথরিটির বিজ্ঞজন ও সাংবাদিকরা বোঝেন না! ইবোলার জন্য আবিষ্কৃত এই ওষুধটি একটি ব্যর্থ ওষুধ। এটা যে করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর হবে তা বড় ধরনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়া বলার উপায় নেই। প্রাথমিক ফলাফলে বলা হলো- এই ওষুধ রোগীর সুস্থ হওয়ার সময় ১৫ দিন থেকে ১১দিনে কমিয়ে আনে। তাও আবার মৃদু আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে।
ইন্টেন্সিভ কেয়ারে থাকা রোগীদের জন্য ভাইরাল লোড বেশি হওয়ার কারণে ফলাফল মোটেই আশাপ্রদ নয়। অথচ বিজ্ঞান ভিত্তিক গ্রহণযোগ্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই আমরা চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলাম- রেমডেসিভির করোনা চিকিৎসায় এক অনন্য ম্যাজিক বুলেট। আর যায় কই! আগপাছ বিচার না করেই বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানির মধ্যে রেমডেসিভির ওষুধটি উতপাদন ও বিপণন নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।
এসবের প্রত্যক্ষ মদদদাতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকলো ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। একটি কোম্পানি ওষুধটিকে একমাত্র কার্যকর ওষুধ আখ্যায়িত করে উৎপাদন সম্পন্ন করে ফেললো। কার আগে কে উতপাদন করলো তা নিয়েও শুরু হলো দ্বন্দ্ব। অথচ পৃথিবীর কোথাও এই ওষুধকে এখনো একমাত্র কার্যকর ওষুধ বলে সার্টিফিকেট দেয়নি।
একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকা ওষুধটির কার্যকারিতা নিয়ে এমনসব হাস্যষ্কর কথাবার্তা বলা শুরু করলো যে, আমি একজন ফার্মাসিস্ট হওয়া সত্বেও মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হলো। তবে পত্রিকাটির সাথে প্রথম রেমডেসিভির উৎপাদনকারী (কনটেস্টেড) কোম্পানির রক্তের সম্পর্ক রয়েছে।
মিডিয়া হাইপের সর্বশেষ সংযোজন হলো করোনা চিকিৎসায় ইভারমেক্টিন ও ডক্সিসাইক্লিন গবেষণার অসাধারণ সাফল্য। ইভারমেক্টিন হলো অ্যান্টিপ্রটোজোয়াল ড্রাগ আর ডক্সিসাইক্লিন একটি আউটডেটেট অ্যান্টিবায়োটিক। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ওষুধ দুটো কীভাবে কার্যকর হতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। তারপরও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কার্যকর প্রমাণিত হলে আমাদের নিতে আপত্তি নেই।
উল্লেখ্য – চিকিৎসকরা বলেছেন তাঁরা কোনো গবেষণাই করেননি, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল তো দূরের কথা। দেখুন মিডিয়ার ঠগবাজি ও তামাশা! একটি পত্রিকা লিখেছে- করোনা চিকিৎসায় বিষ্ময়কর সাফল্য দেখছেন বাংলাদেশী গবেষকদল। অন্য একটি পত্রিকা লিখেছে- দেশে করোনা চিকিৎসায় বড় সাফল্য।
মিডিয়ায় বলা হয়- এই দুটো ওষুধ প্রয়োগে তিন দিনে ৫০ শতাংশ করোনা রোগের লক্ষণ কমে যায় ও চারদিনে করোনা টেস্ট পজিটিভ থেকে শতভাগ নেগেটিভ হয়ে যাওয়ার বিষ্ময়কর সাফল্য অর্জিত হয়। বলে রাখা ভালো- চিকিৎসকরা কিন্তু পত্রিকার অতিরঞ্জিত স্টান্টবাজিকে সমর্থন না করে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
আমার কথাঃ বক্ষব্যাধী হাসপাতালের সম্মানিত চিকিৎসকরা সিরিয়াসলি অসুস্থ কোনো রোগীকে এই দুটো ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করেননি। ৬০জন মৃদুু করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে তাঁরা ওষুধ দুটো প্রয়োগ করেন। করোনায় আক্রান্ত পৃথিবীর ৮০ শতাংশের বেশি রোগী কোনো ওষুধ ছাড়াই ভালো হয়ে যাচ্ছে। এধরণের রোগীদের আটা বা ময়দার তৈরি ট্যাবলেট খাওয়ালেও তারা ভালো হয়ে যাবে। এটাকে বলা হয় প্ল্যাসিবো ইফেক্টে।
এখন রোগী কি এমনি এমনি ভালো হলো নাকি ওষুধের কারণে ভালো হলো তা কে বলবে? এই দুটো ওষুধের কার্যকারিতা কি রেন্ডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে? তা হয়নি। চিকিৎসকরা তা দাবিও করেননি। তাহলে কিসের ওপর ভিত্তি করে আমাদের দেশের বাচাল ও অপরিপক্ক মিডিয়া অহেতুক বিভ্রান্তি ও প্রতারণায় মত্ত হয়ে পড়েছে। এ দেশের মানুষকে মিডিয়াওয়ালারা কী ভাবেন? এদেশের সব মানুষ পাগল না উন্মাদ !! # লেখক:- ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মুহিদ ইসলাম ।
?
1
2:41