আরিফ আজাদ, অতিথি লেখকে মন্তব্য প্রতিবেদন:
শুধু বাংলাদেশ নয় ,পুরো বিশ্ব আজ প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের হিংস্র থাবায় তছনছ হয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বে প্রায় ২৩/২৪ হাজার মানুষ মারা গেছেন। আরো অর্ধকোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কেউ স্বেচ্ছা আর কেউ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের জারি করা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন। পুরো বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ বর্তমানে এক ধরনের গৃহবন্ধি জীবন যাপন করছেন। আর এই পরিস্থিতিতে কিছু দিক নির্দেশনা ও পরামর্শকমূলক একটি ছোট
মন্তব্য প্রতিবেদনটি অনলাইন নিউজ পোটাল ‘ দূরবীন নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ‘ প্রকাশ করা হলো।
নিম্মে লেখকের প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো।
# যেদিন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) হযরত আবু বাকার সিদ্দিক (রাঃ) কে সাথে নিয়ে মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেন। ওইদিন ঊষালগ্নে, মদিনায় যাবার পথে তাঁরা দুজনে একটা গুহার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। পেছন থেকে শত্রু যখন একেবারে নাকের ডগায় চলে এলো, একেবারে গুহার মুখে, তখন ক্ষণিকের জন্য ভয় পেয়ে যান আবু বকর সিদ্দিক ( রাঃ)।
তিনি বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাঃ) এই বুঝি তারা আমাদের দেখে ফেললো’। তখন নবীজী (সাঃ) প্রতি উত্তরে যা বলেছিলেন, তা কুরআনে স্থান পেয়ে গেছে। তিনি বলেছিলেন, ‘হতাশ হয়োনা। নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’।
# নবীজী (সাঃ) এর ওপর ঘনিয়ে এসেছিলো এক ঘোরতর বিপদ। মক্কার মুশরিকেরা তাঁকে হত্যা করার পাঁয়তারা করছিলো। তখন, আল্লাহর নির্দেশে নবীজী (সাঃ) এই বিপদ এড়াতে মক্কা ছেড়ে মদীনা অভিমুখে রওনা করেন। দেখুন, বিপদ থেকে বাঁচার জন্য নবীজী (সাঃ) এর কি কোন তাওয়াক্কুল ছিলো ? না , তিঁনি কি ভেবেছেন, ‘আরে! আল্লাহ বাঁচালে আমাকে মক্কাতেই বাঁচাবেন।
মারলে মক্কাতেই মারবেন। আমি মক্কা ছাড়বো কেনো?’
আর, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালাও কি তাঁকে দিয়ে এমনটা করিয়েছেন? না। তিঁনি বরং নবীজী সঃ’কে মক্কা ছেড়ে চলে যেতে বললেন। নবীজী সঃ’র তো তাকওয়ার কোন ঘাটতি ছিলোনা। তাওয়াক্কুলের কোন কমতি ছিলোনা। এমন ধারণা করাই পাপ হবে।
তাহলে কেনো তাঁকে সেদিন মক্কা ছাড়তে হলো? অবশ্যই সতর্কতার অংশ হিশেবে। শত্রুর চোখ এড়াতে কেনো তাঁকে গুহার মধ্যে আশ্রয় নিতে হলো? আল্লাহ তো চাইলে তাঁকে এমনিই বাঁচিয়ে দিতে পারতেন। এটাও সতর্কতা। আর, এই সতর্কতা কখনোই তাওয়াক্কুল পরিপন্থী নয়।
# হযরত মুসা (আঃ) এর কথাই ধরুন। পেছনে ফেরাউনের বিশাল সৈন্যবহর, আর সামনে কূল-কিনারাহীন লোহিত সাগর। এমতাবস্থায় ঘাবড়ে গেলো হযরত মূসা (আঃ) এর সঙ্গীরা। ভাবলো, ‘এই বুঝি তারা আমাদের ধরে ফেললো’। তখন হযরত মুসা (আঃ) শোনালেন অভয় বাণী। বললেন, ‘আল্লাহ সাথে আছেন’।
এমন মুহূর্তে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা হযরত মুসা (আঃ) কে কি করতে বললেন? তিঁনি মুসা আলাইহিস সালামকে বললেন তার লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত করতে। হযরত মুসা (আঃ) তা-ই করলেন, আর সাথে সাথে সমুদ্র দুভাগ হয়ে, তাতে তৈরি হয়ে গেলো একটি শুষ্ক রাস্তা। আচ্ছা, কেনোই বা মুসা আঃকে লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত করতে হলো? আল্লাহ কি চাইলে এমনিতেই রাস্তা তৈরি করে দিতে পারেন না? কিন্তু না, আল্লাহ চান বান্দা যেন তার চেষ্টাটুকু করে। বাকিটা আল্লাহর হাতে।
# হযরত নূহ (আঃ) এর কথা স্মরণ করুন। যখন তাঁর জাতি একেবারে অবাধ্য, উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠলো, যখন তাদের ওপর আল্লাহর আযাব অত্যাসন্ন হয়ে আসলো, তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা হযরত নূহ (আঃ ) কে বললেন, একটা নৌকা তৈরি করে নিতে। তাঁর জাতির ওপরে যে ভয়ঙ্কর বন্যা আপতিত হবে, তা থেকে বাঁচার জন্যে তারা যেন সেই নৌকায় উঠে পড়ে।
খেয়াল করুন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা কি চাইলে হযরত নূহ (আঃ) কে নৌকা বানানো ব্যতীতই সেই বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন। কিন্তু, তিনি কেনো তাহলে নুহ আঃকে নৌকা তৈরির আদেশ করেছিলেন? ওই যে, আল্লাহ চান বান্দা যেন তার নিজের চেষ্টাটুকু করে। সে যদি আন্তরিক হয়ে নিজের কাজটুকু করে ফেলে, সেটাকে সম্পূর্ণতা আল্লাহ দিয়ে দেন।
# বিবি মারঈয়াম এর কথা স্মরণ করা যায় এখানে। ঈসা আঃকে গর্ভে ধারণ করার পরে যখন তার প্রসববেদনা শুরু হয়, সেদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা তাঁকে একটা খেঁজুর গাছের ডাল ধরে নাড়া দিতে বলেছিলো। ডাল ধরে নাড়া দিলে খেঁজুর ঝরে পড়বে এবং ওই খেঁজুর তিনি খেতে পারবেন।
দেখুন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা হুকুম করলে গাছ থেকে খেঁজুর কি এমনিই ঝরে পড়তো না বিবি মারঈইয়াম জন্য? অবশ্যই পড়তো। কিন্তু তিঁনি তা না করে, মারঈয়াম আঃকে ওই অবস্থায়, যখন তিঁনি প্রসববেদনায় কাতর, তখন বললেন গাছের ডাল ধরে নাড়া দিতে।
কেনো বলেছিলেন? আগেই বলেছি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা চান বান্দা যেন তার নিজের দায়িত্বটুকু, নিজের চেষ্টাটুকু করে, আর বাকিটা আল্লাহর ওপর সোপর্দ করে দেয়।
# আজকে, আমাদের সামনে এসেছে এক ভয়াবহ দুঃসময়। আমরা অবলোকন করছি একটি ভয়ঙ্কর মহামারী কাল। এই দুঃসময় কাটাতে হলে, আমাদের অবশ্যই অবশ্যই আমাদের দায়িত্বটুকু পালন করতে হবে। আমরা যদি আমাদের দায়িত্বটুকু পালন করি, আশা করা যায়, ইন শা আল্লাহ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা এই বিপদ থেকে উত্তরণের পথ আমাদের জন্য সহজ করে দেবেন।
‘’এতো সতর্ক হয়ে কি হবে? আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দেবেন। আর মরণ থাকলে তো মরতে হবেই’’- এই জাতীয় কথাবার্তা যারা বলছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর ঘটনাটা আরেক বার পড়ার জন্যে। তাঁকে হত্যার চক্রান্ত হচ্ছে জানতে পেরে তিঁনি মক্কা ত্যাগ করেছেন। শত্রুর চোখ এড়াতে তিঁনি গুহার ভিতরে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বিপদের মুখে তিঁনি, ‘আরে, আল্লাহ বাঁচিয়ে দেবে’ বলে গা ছাড়া ভাব দেখাননি। বরং, বিপদ এড়াতে নিজের যেটুক করা দরকার, তার সবটুকু করেছেন। সাথে রেখেছেন আল্লাহর ওপর অগাধ তাওয়াক্কুল। এটাই তো নববী পদ্ধতি। তাহলে, আমরা কিভাবে এতো উদাসীন হচ্ছি? এতো অসতর্ক থাকছি? ভাবুন তো, এটা কি সত্যিই তাওয়াক্কুলের অংশ কিনা? ঈমানের জজবা কিনা?
হযরত মুসা (আঃ) নিজের চেষ্টা করেননি? নূহ আঃ নিজের চেষ্টা করেননি? মারঈয়াম আঃ প্রসববেদনা নিয়ে নিজের চেষ্টা বাদ রেখেছিলেন? না। তাহলে, কোন ঈমানের বলে, কোন তাওয়াক্কুলের বলে আমরা এমন গা ছাড়া ভাব দেখাচ্ছি আর বলছি- ‘আরে, আমার কিচ্ছু হবেনা?’
নবীজী (সাঃ) র একটা হাদিস থেকে আমরা জেনেছি, মহামারীতে কোন ঈমানদার ব্যক্তি মারা গেলে তিনি শহিদের মর্যাদা পাবেন। নিঃসন্দেহে খুব ভালো মর্যাদা। কিন্তু, এই হাদিস টেনে যারা বলছেন, ‘‘আরে, মরলে তো শহিদ হবো। তাহলে এতো ভয় কিসের? শহিদ হওয়ার সাধ নেই মনে?’’
সত্যি? মহামারীতে মরলে শহিদ হবেন- এজন্যে আপনি মহামারীকে পাত্তা দিতে চাইছেন না? শহিদ হওয়ার জন্যে? তাহলে, নবীজী (সাঃ) যে বলেছেন, মহামারী আক্রান্ত এলাকায় বাইরে থেকে যেন কেউ না ঢুকে, ভিতরের কেউ যেন বাইরে না যায়’- এই হাদিসটাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? শহিদ হওয়া এতো সহজ হলে তো তিনি উৎসাহ দিতেন বেশি করে মহামারী এলাকায় ঢুকার জন্যে।
আর, সেদিন যে হযরত ওমর (রাঃ) এতোগুলো সাহাবিদের নিয়ে মহামারী আক্রান্ত এলাকায় না ঢুকে চলে এসেছিলেন, তাহলে তারা কি শহিদ হয়ে যাওয়ার সুযোগটা হারিয়েছেন? লুফে নেননি? আসলে, আপনি কি শহিদ হতে চাচ্ছেন না আত্মহত্যা করতে চাচ্ছেন, তা আরেকবার ভেবে দেখবেন কি?
হাদিস থেকে জানা যায়, আগুনে পুড়ে মরলেও শহিদ, আর পানিতে ডুবে মরলেও শহিদ। এমনকি, পেটের রোগে অসুস্থ হয়ে মারা গেলেও শহিদের মর্যাদা পাওয়া যাবে।
তো, ভাইজানেরা, আপনার বাসায় আগুন লাগলে শহিদ হওয়ার জন্য আপনি কি বাসার মধ্যে বসে থাকবেন? আপনার লঞ্চ ডুবতে থাকলে আপনি কি সাঁতরাবেন না? নিজ থেকেই পানিতে গা এলিয়ে দেবেন? কিংবা, পেটের অসুখে ধরলে ডাক্তারের কাছেও যাবেন না?
ওই যে, যা বলছিলাম, এই মহামারী থেকে বাঁচতে আমাদের সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ বলেছেন, ‘তিনি ওই জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যে জাতি নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন না করে’। আপনি আর আমি যদি চেষ্টাই না করি, ভাগ্যটা পরিবর্তন হবে কি করে?মাদের চেষ্টাটুকু তো করতে হবে, এরপর অপেক্ষা করতে হবে আল্লাহর ফয়সালার জন্যচেষ্টা করার পরেও এই মহামারীতে যদি আমাদের মৃত্যু হয়, তখন আমরা শহিদের মর্যাদা লাভ করবো ইন শা আল্লাহ। কিন্তু বিনা চেষ্টায় যদি শহিদ হওয়ার জন্যে হাত-পা ছেড়ে বসে থাকি, তা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই হবেনা।
তাহলে, চেষ্টা কিভাবে করবো?
বিশেষজ্ঞরা আমাদের যা জানাচ্ছেন তা-ই করতে হবে। যতোটা সম্ভব একা একা থাকতে হবে। বেশি মানুষ একত্র হয়, এমন স্থানে কোনোভাবেই যাওয়া যাবেনা। সম্ভব হলে, ঘরে বন্দী হয়ে যেতে হবে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে। বাইরে বেরুতে হলে, অবশ্যই মাস্ক, প্রয়োজনে হ্যান্ড গ্লাভস পরতে হবে। বিদেশ থেকে এসেছে, এমন কারো সংস্পর্শে যাওয়া যাবেনা।
বেশি বেশি হাত ধুতে হবে। হাত না ধুয়ে নাক-মুখ-চোখ স্পর্শ করা যাবেনা কোনোভাবেই। পুষ্টিকর খাবার-দাবার খেতে হবে যাতে শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভালো থাকে। একটা পরিবার সতর্ক থাকা মানে একটা পরিবার নিরাপদ থাকা। এভাবে, ব্যক্তিগতভাবে যদি আমরা সতর্ক হই, কতোগুলো পরিবার নিরাপদ হতে পারি, তা কি ভেবেছেন?
আপনারা উদ্যোগগুলোকে ছোট ভাববেন না। এই সময়ে, আপনার এই উদ্যোগ দিনশেষে বিশাল প্রতিফল হয়ে ফিরে আসবে, ইন শা আল্লাহ। তাওবা-ইস্তিগফারে বেশি বেশি সময় দিবেন। মোনাজাতে সবার জন্য দুয়া করবেন।
মনে রাখবেন, আপনি অন্যের নিরাপত্তা চেয়ে যখন দুয়া করেন, ফেরেশতারা তখন ওই একই দুয়া আপনার জন্যে করে।
এই বিপদে আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে, ধৈর্য ধারণ করতে হবে , সরকারের নির্দেশনা মানতে হবে । আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। তা হলেই প্রাণঘাতি ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাস এবং ডিঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ নানা রোগ বালাই থেকে বাাঁচায় উপায় আছে। # কাশেম