দূরবীণ নিউজ প্রতিনিধি :
ঋণ জালিয়াতির মামলায় বিনাদোষে পাটকল শ্রমিক জাহালমকে প্রায় ৩ বছর কারাগারে আটক রাখার ঘটনায় ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ব্র্যাক ব্যাংককে নির্দেশসহ ৮৮ পৃষ্টার রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
উচ্চ আদালত একই সঙ্গে ঋণ জালিয়াতির মামলার তদন্তকারী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কড়া ভাষায় সতর্ক করেছেন। প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ভুলভাবে কাউকে যেন মামলায় জড়ানো না হয়।
রোববার (৭ আগস্ট) ৮৮ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। তিনি বলেন, ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বে এ রায় ঘোষনা করেন।
দুদকের আইন জীবী গণমাধ্যমকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ে ব্র্যাক ব্যাংককে রায়ের কপি হাতে পাওয়ার এক মাসের মধ্যে নিরপরাধ জাহালমকে ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে। আর টাকা দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার জেনারেলের কার্যালয়ে লিখিতভাবে জানাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ২০২০ সালে ব্র্যাক ব্যাংক হাইকোর্টের এই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেছিল। তবে এখন তারা পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে লিভ টু আপিল করতে পারে। এর আগে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১২ সালের এপ্রিলে মোট ৩৩টি মামলা করে দুদক।
দুদক তদন্ত করে জালিয়াত চক্র সোনালী ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখায় আবু সালেকসহ ৩জনের হিসাব থেকে ১০৬টি চেক ইস্যু করে। চেকগুলো ১৮টি ব্যাংকের ১৩টি হিসাবে ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জমা করে ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ওই ১৮টি ব্যাংকের মধ্যে একটি হলো ব্র্যাক ব্যাংক।এরপর দুদকের নবীন অনভিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুলে সালেকের বদলে গ্রেফতার করা হয় টাঙ্গাইলের পাটকল শ্রমিক জাহালমকে। তাকে ‘আবু সালেক’ হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন ব্র্যাক ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা। ওই কারণে ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এই জরিমানা দিতে বলা হয়।
আদালত রায়ে বলেছেলেন, এ ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের কোনো ভুল না পাওয়ায় তাদের জরিমানা করা হয়নি। তবে দুদককে হাইকোর্ট সতর্ক করে দিয়েছেন, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না হয়।
রায়ে হাইকোর্ট বলেন, দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা যথাযথভাবে তার দায়িত্ব পালন করেনি। তদন্ত রিপোর্টেও এটা উঠে এসেছে। কিন্তু সব দেখে মনে হয়েছে তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে ছিল না। এখানে দুদকের ৩১ ধারা (সরল বিশ্বাসের ভুল) প্রযোজ্য। যদিও তারা অদক্ষ ও অযোগ্য। কিন্তু আমরা ওই অফিসারদের প্রতি ক্ষতিপূরণ আরোপ করছি না। এখানে সালেকের স্থলে জাহালমকে জড়ানোর কোনো উদ্দেশ্যে দেখছি না।
দুদকের বিষয়ে হাইকোর্ট বলেন, দুদক একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত স্বাধীন কর্তৃপক্ষ। আইন ও বিধি অনুসারে তাদের তদন্ত কার্যক্রম চালাবে, এবং ভবিষ্যতে কোনো মামলায় কোনো ব্যক্তিকে এ ধরনের ভুলভাবে যেন জড়ানো না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের সম্পর্কে আদালত রায়ে বলেন, তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, বিশেষত ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা সালেকের স্থলে জাহালমকে এনেছেন। তাদের এ কার্যক্রম তদন্ত কর্মকর্তাকে ভুল পথে পরিচালিত (মিসগাইড) করেছে। আর তারা ইচ্ছা করে এ কাজ করেছে।ওই সময় ব্যাংক ঋণ সংক্রান্ত ঘটনায় ৩৩ মামলায় জাহালমকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল।
হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, জাহালমের মতো আর কোনো নিরীহ লোক যেন ভবিষ্যতে দুদকের মামলায় জেল না খাটে। দুদককে যথাযথভাবে তদন্ত করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বে এ রায় দেন।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশগুপ্ত। ৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামী জেলে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না…’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘স্যার, আমি জাহালম। আমি আবু সালেক না, আমি নির্দোষ।’ ২০১৭ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এ বিচারকের উদ্দেশ্যে তাকে বারবার বলতে দেখা যায়, ‘আমি আবু সালেক না। ’
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবু সালেকের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটেন নির্দোষ জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুদকের কর্মকর্তা, মামলার বাদীসহ ৪জনকে তলব করেন হাইকোর্ট ।
এছাড়া রুলও জারি করেন। পরে একই বছরের ২০১৯ সালে ৩ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্টরা হাজিরের পর হাইকোর্ট জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ দেন এবং দুদকের কাছে ঘটনার বিষয়ে হলফনামা আকারে জানতে চান। সে আদেশ অনুসারে দুদক হলফনামা আকারে তা উপস্থাপন করে। পরে ব্যাংক ঋণ জালিয়াতির ৩৩ মামলার এফআইআর, চার্জশিট, সম্পূরক চার্জশিট ও সব ব্যাংকের এ সংক্রান্ত নথিপত্র দাখিল করতে দুদককে নির্দেশ দেন। এ ঘটনার তদন্ত করে দুদক জানায়, জাহালম নিরপরাধ। একই মত দেয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও। #