দূরবীণ নিউজ প্রতিনিধি:
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) উপ-প্রধান ইস্কান্দার মিয়া বলেছেন,শত শত কোটি টাকা পাচারকারী ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতরা সমাজে অনেক ক্ষমতাবান। তাদের বিরুদ্ধে তদন্তে নামলে বেকায়দার পড়েন তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। অনিয়ম-দুনীতি আড়াল করতে তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দেখানো হয়। তিনি বলেন, ওই ক্ষমতাবানদের পক্ষ থেকে ঘুষ নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
প্রস্তাবে রাজি না হলে এক ধরনের হুমকিতে থাকেন তদন্ত কর্মকর্তারা এবং নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েন তাদের পরিবারের সদস্যরাও। যার ফলে তদন্ত কর্মকর্তা চাইলেও সততার সঙ্গে কাজ করতে পারেন না। তিনি বলেন, বিদেশে অর্থপাচার ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করেন বিএফআইইউ’র কর্মকর্তারা। তবে তাদের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই বললেই চলে।
বুধবার (৯ নভেম্বর) রাজধানীর পল্টনে ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় ও ডিজিটাল মাধ্যম’ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি শারমীন রিনভী। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের পরিচালনায় সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) উপ-প্রধান ইস্কান্দার মিয়া, পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর,বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ, ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মনিরুল মওলা, বিকাশের প্রতিনিধি শেখ মনিরুল ইসলাম। সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপক ও সানেম চেয়ারম্যান বজলুল খন্দকার।
বিএফআইইউ’র উপ-প্রধান বলেন, আমাদের দেশের শ্রমিকরা বিদেশে অনেক পরিশ্রম করে দেশে অর্থ পাঠান। কিন্তু তাদের সুখ-দুঃখ দেখার কেউ নেই। প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ের ৩০ শতাংশের বেশি অর্থ বৈধ পথে পাঠানোর সুযোগ নেই। তাই বাধ্য হয়েই তারা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান। তাছাড়া দেশের বৈধ চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডিচক্র অনেক বেশি শক্তিশালী। এছাড়া বৈধ পথে টাকা পাঠাতে সরকারিভাবে যেসব সেবা রয়েছে সেগুলোতে খুব ঝামেলা পোহাতে হয়। এজন্যই নিজেদের সুবিধা মতো বিকল্প ব্যবস্থা বেছে নিচ্ছেন প্রবাসীরা।
ইস্কান্দার মিয়া আরও বলেন, আমাদের দূতাবাসগুলো সাহায্যকারী না। অন্যদিকে যারা মাদক বা চোরাকারবার তারা শক্তিশালী। চোরাইপথে ডলারের দাম বেশি দেওয়া হচ্ছে। আমরা সহজেই অবৈধভাবে আদান-প্রদান করতে পারছি। দূতাবাসগুলো প্রবাসীদের খোঁজ-খবর নিলে এটা করতে পারতো না। আমাদের অনেকেই সোনা আনছে বা ডলার আনছে। কিন্তু সেসব ডলারগুলো ব্যাংকে যাচ্ছে না তাহলে যাচ্ছে কোথায়? আমরা তাদের অবৈধতার বিষয়ে বলতে পারলে তারা বৈধভাবে রেমিট্যান্স পাঠাবে, হুন্ডি হবে। আবার অবৈধতার বিষয়ে আমাদের ব্যাংকের তদন্তকারী যখন তদন্তে যান তখন তাদের অর্থের লোভ দেখানো হয়।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আমরা প্রবাসীদের কাছ থেকে কৌশলে রেমিট্যান্স আনার চেষ্টা করছি। প্রবাসীরা না খেয়ে আবেগে টাকা পাঠান মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের জন্য। আগে দেখতাম প্রবাসীদের টাকা ব্যাগে করে দিয়ে যেতেন অপরিচিত কিছু লোক। তারা প্রবাসীর পরিবারের কাছে এসে খাওয়া-দাওয়া শেষে টাকার প্যাকেট দিয়ে যেতেন। প্রথমে আমরা বুঝিনি, এখন বুঝছি তারা হুন্ডিওয়ালা। মধ্যপ্রাচ্যে যারা লোক পাঠান তাদের অক্ষরজ্ঞান নেই, তাদের একটু প্রশিক্ষণ দিলে দক্ষ হিসেবে কাজ করতে পাৎরেন। আমাদের যে লোকটা উটের পিঠে হাটেন, অন্য দেশে গেলে তিনি অনেক টাকা পাবেন।
তিনি বলেন, আজ দেশের বাইরে গেলে কাল অনেকেই ৫-১০ লাখ টাকা পাঠাচ্ছেন। নিশ্চয়ই হুন্ডি হচ্ছে। তবে হুন্ডিওয়ালাদের বাইরেও বিদেশে থেকে টাকা পাঠানো হয়। অনেকে এজেন্টের মাধ্যমে টাকা পাঠায়,এই প্রথাটা ভাঙতে হবে। দূতাবাসের অবস্থাও পরিবর্তন করতে হবে। সেখানে কোনো এজেন্টের মাধ্যমে না কথা বলে সরাসরি কথা বলতে হবে। আবার দূতাবাস কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ভালো ব্যবহার করতে হবে। কারণ রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই অর্থনীতি শক্তিশালী হয়।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রতি মাসেই এক, দুই বিলিয়ন করে রিজার্ভ হারাচ্ছি। এর মানে বাজারে ডলার ছাড়ছি এবং রিজার্ভ কমছে। রপ্তানি বাড়াতে হবে এবং আমদানি নির্ভরতা থেকে সরে আসতে হবে।
তিনি বলেন, আমেরিকা থেকে বৈধ পথে বেশি রেমিট্যান্স আসছে, কেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে কম আসছে। লোকালি প্রবাসীদের কাছে যেতে হবে, তাদের কথা শুনতে হবে। মার্কেটগুলোতে আমাদের প্রচার করতে হবে যে আপনারা (প্রবাসী) শুধু আমাদের ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠান। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে পারে। শুধু ফরমাল মার্কেট না কার্ব মার্কেটগুলোতেও কিছু ডলার দিতে হবে।
মাশরুর রিয়াজ বলেন, আমাদের চার স্থান থেকে রিজার্ভ আসতো। এর মধ্য অন্যতম হলো রেমিট্যান্স। এখন রেমিট্যান্স কমেছে এটাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে মোবাইলে আর্থিক সেবায় (এমএফএস) আমরা ভারত-শ্রীলঙ্কার পরে শুরু করলেও আমরা ভালো করছি। ডিজিটাল ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে আমাদের আরও উন্নতি দরকার। দুবাই থেকে রেমিট্যান্স কমেছে কেন সেটা খুঁজে বের করতে হবে। আবার সেই দুবাইয়ে আবাসন খাতে আমাদের বিনিয়োগ বেড়েছে এটাও দেখতে হবে।
অধ্যাপক বজলুল খন্দকার বলেন, এমএফএসে ৫৫ দেশের মধ্যে আমরা ৪৪তম। ভারত- কেনিয়াসহ যারা এগিয়ে আছে তাদের স্কোর ৭৫ প্লাস, আমাদের ৪০ প্লাস। রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে ডিজিটাল কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে এবং ডিজিটাল শিক্ষা বৃদ্ধি করতে হবে।
ইসলামী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী মনিরুল মওলা বলেন, আমাদের ব্যাংক শুরু হয়েছিল রেমিট্যান্স দিয়ে। আমরা রেমিট্যান্সে গুরুত্ব দিয়ে আসছি। ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ যখন ছিল, আমরা সেখানে ১২ বিলিয়ন ডলার জমা দিয়েছিলাম। প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় আমরা কাজ করেছি, সেখানে অ্যাকাউন্ট ওপেন এবং পাঠানোর বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেছি। ২৪ ঘণ্টার যেকোনো সময় রেমিট্যান্স পাঠাতে পারেন, এতে আস্থাভাজন ব্যাংকে পরিণত হয়েছে ইসলামী ব্যাংক। প্রতি ৫ কিলোমিটার দূরে আমাদের এজেন্ট ব্যাংকিং আছে।
শেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, বিকাশে সরাসরি রেমিট্যান্স আসে না, ব্যাংক সেটেলমেন্টের মাধ্যমে আসে। এটা হতে পারে কোনো ব্যাংক বা ব্যাংকের নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট থেকে আসে। সেটেলমেন্ট ছাড়া বিকাশের মাধ্যমে দেশের বাইরে যেতে পারে না আবার আসতেও পারে না। নভেম্বরে গড়ে দেড় মিলিয়ন পরিমাণ ডলার আসছে। বিকাশে রেমিট্যান্স এলে তার প্রণোদনা ও মূল টাকার বিষয়ে আমরা এসএমএস করে পাঠিয়ে দেই সঙ্গে সঙ্গেই। #